ব্যাটারি নিয়ে সম্ভাবনাময় গবেষণা, দলে আছেন বাংলাদেশের ওয়াহিদ

0
182
ওয়াহিদুল হাসান

বলুন তো, কোন যন্ত্রটি বিলাসবহুল গাড়ি থেকে শুরু করে মুঠোফোন, এমনকি দেয়ালঘড়িতেও থাকে?

উত্তর—ব্যাটারি। ভবিষ্যতের প্রযুক্তিতেও অত্যাধুনিক ব্যাটারি নিশ্চয় বড় ভূমিকা রাখবে। এই ব্যাটারি নিয়ে গবেষণার জন্যই সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ডলারের তহবিল পেয়েছে একটি গবেষক দল। দলে আছেন বাংলাদেশি তরুণ ওয়াহিদুল হাসান। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) স্নাতক তিনি। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলে পড়া ওয়াহিদ কীভাবে নাসা পর্যন্ত পৌঁছলেন?

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই শুরু

তড়িৎকৌশলই যে আগ্রহের জায়গা, ছেলেবেলা থেকেই জানতেন ওয়াহিদ। তাই পড়ার বিষয়, লক্ষ্য—এসব নিয়ে তাঁকে খুব একটা ভাবতে হয়নি। সময়টা ২০১১। ওয়াহিদ ভাবছিলেন, গরুর গোবর দিয়ে যদি গ্যাস তৈরি করা সম্ভব হয়, তাহলে বিদ্যুৎ কেন নয়? প্রাথমিকভাবে গোমূত্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করেন তিনি। বাজারের সাধারণ ব্যাটারিগুলোর ভেতর অ্যাসিডের পরিবর্তে গোমূত্র দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, কিছুটা সুফলও পান। কিন্তু সমস্যা ছিল ভোল্টেজের স্থায়িত্ব নিয়ে। নানা পদ্ধতির ব্যবহার করে অবশেষে সমাধান খুঁজে পান তিনি।

একজন শিক্ষকের পরামর্শ নিয়ে ঢাকার একটি গরুর খামারে আরও বিস্তৃত পরিসরে কাজ শুরু করেন ওয়াহিদ। কাজে নেমে জানতে পারেন, সাধারণভাবে গোমূত্রে থাকা অ্যাসিড মাটি ও ঘাসের জন্য ক্ষতিকারক হলেও ব্যাটারিতে ব্যবহার করা মূত্রে সেই ক্ষতি হয় না। বরং উচ্ছিষ্ট অংশ সারের মতো কাজ করে। এরপর আরও উদ্যমে কাজ শুরু করেন তিনি। গবাদিপশুর মূত্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২১ সালে এলসিভিয়ার ফাউন্ডেশন কেমিস্ট্রি ফর ক্লাইমেট অ্যাকশন চ্যালেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড জেতেন ওয়াহিদ।

নাসার তহবিল যেভাবে এল

তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলে পড়লেও স্নাতকোত্তর শেষে ওয়াহিদের কর্মজীবন শুরু হয় নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েরই কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে, প্রভাষক পদে। সেখান থেকেই ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান পিএইচডি ডিগ্রির জন্য। কিন্তু সে সময় পিএইচডির বিষয় তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্রের সঙ্গে ঠিক মিলছিল না। হতাশ না হয়ে ওয়াহিদ সুযোগ খুঁজছিলেন। অবশেষে সে সুযোগই মিলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্কুল অব মাইনস অ্যান্ড টেকনোলজিতে। সেখানকার সহযোগী অধ্যাপক ওয়েবিং জিংয়ের সঙ্গে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।

গবেষণাদলের সঙ্গে ওয়াহিদ
গবেষণাদলের সঙ্গে ওয়াহিদ ছবি: সংগৃহীত

ভুট্টার ডাঁটা থেকে কার্বন আলাদা করে সালফার ও অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিলিয়ে ন্যানো-পলিমার কার্বন তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন তাঁরা। প্রাথমিকভাবে তেমন আশানুরূপ ফল না পেয়ে ভিন্ন কিছুর কথা ভাবছিলেন জিং। কিন্তু ওয়াহিদ ছিলেন নাছোড়বান্দা। প্রতিনিয়ত পরীক্ষায় হঠাৎ একদিন দেখতে পান, এই কার্বনে যে মাত্রা (বিইটি সারফেস এরিয়া) পাওয়া যাচ্ছে, তা স্বাভাবিক কার্বনের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ এটি কাজে লাগিয়ে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব, যা বাজারের প্রচলিত ব্যাটারি থেকে কয়েক গুণ বেশি কার্যকর। একই প্যাটার্নে তৈরি বাকি মডেলগুলোতেও যখন একই ফলাফল পাওয়া গেল, তখন ওয়েবিং জিংও ভরসা পাওয়া শুরু করলেন। নিজের অন্য কাজ জমা না দিয়ে এ কাজই জমা দেন গবেষণা তহবিলের জন্য। দীর্ঘ পাঁচ মাস নানা প্রক্রিয়া পেরিয়ে নির্বাচিত হয় ওয়াহিদদের এ গবেষণা।

বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণাকে সহযোগিতা করার জন্য ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে তিন বছরব্যাপী মোট ১০ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি তহবিল দেবে নাসা, যার মধ্যে ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার (প্রায় ৮ কোটি টাকা) পাবে ওয়াহিদের দল। নাসার এস্টাবলিশড প্রোগ্রাম টু স্টিমুলেট কম্পেটিটিভ রিসার্চ প্রকল্পের আওতায় এ তহবিল দেওয়া হবে।

গবেষণাটির গুরুত্ব

ওয়াহিদদের গবেষণাটি মহাকাশ অভিযানকে আরও সহজ করবে বলে মনে করছে নাসা। নাসার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ব্যাটারির সক্ষমতা ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পেলে এটি মহাকাশযানের উন্নয়ন, মঙ্গল গ্রহে অভিযানসহ নানা ক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে। গবেষণার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ওয়েবিং জিং বলেন, ‘আমরা একটি লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির ক্যাথোডে বায়োকার্বনের একটি ন্যানো-স্তর আবরণ পেয়েছি, যা পৃথিবীতে আগে কখনো পাওয়া যায়নি।’

ওয়াহিদ অবশ্য বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলেন আরও বড় পরিসরে। তিনি বলেন, ‘গবেষণাটির সফল বাস্তবায়ন হলে ব্যাটারিচালিত গাড়ি নতুন যুগে প্রবেশ করবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয় রোধ করার পাশাপাশি তেলচালিত গাড়িগুলো যেভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছে, সেটিও রোধ করা সম্ভব হবে। চিকিৎসাক্ষেত্রেও এটি কাজে লাগানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে।’

এত বড় একটি গবেষণায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার আনন্দের পাশাপাশি কিছুটা আফসোসের কথাও বললেন ওয়াহিদ। দেশে এ ধরনের গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ না থাকাটা আফসোসের অন্যতম কারণ। ওয়াহিদ বলেন, ‘আমি চাই বাংলাদেশে এ ধরনের রিসার্চ ল্যাবরেটরি হোক। বাংলাদেশ থেকেও আমি ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত থাকতে পারব। এ ক্ষেত্রে নাসার কোনো বাধা নেই। দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারের এগিয়ে আসতে হবে। আমি চাই বাংলাদেশে বসেই যেন আমরা নাসাকে বলতে পারি, আমাদের দেশে এ ধরনের গবেষণা করা সম্ভব।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.