সাত বছরের এহতেশাম রেজা আরহাম আর তিন বছরের এনায়া রেজা আরোয়া। জন্মের পর মা-বাবা ছাড়া থাকেনি কখনও। এখন সেই প্রিয় মা-বাবা হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণাদায়ক সময় পার করছেন। এক দুর্ঘটনায় দুই ভাইবোনের বদলে গেছে চেনা জীবন। দু’দিন আগে মোহাম্মদপুরে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে দুই শিশুর মা ব্যাংকার আফরোজা আহমেদ তিন্না (৩৪) ও বাবা প্রকৌশলী ইমরান রেজা (৩৮) রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভিডিওকলে ওই দম্পতিকে দেখে কাঁদছে তাদের দুই শিশু।
গতকাল বুধবার দুপুরে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের সামনে মলিন মুখে বসে আছেন ইমরান রেজার বাবা রফিকুল ইসলাম। ছেলে ও পুত্রবধূর শারীরিক অবস্থা কেমন জিজ্ঞাসা করতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে বললেন, ‘আমার সুখের সংসার। কোনো দুঃখ-কষ্ট ছিল না। পুত্রবধূ আমার মেয়ের মতো। তার অবস্থা খুবই খারাপ। দুপুর ১টায় অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে তাকে। ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগবে অপারেশন করতে। ছেলের অবস্থাও গুরুতর।’
তিনি জানান, আফরোজার মেরুদণ্ডের ৪-৫টা হাড় ও বাঁ পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙে গেছে। এ ছাড়া কপাল ও মাথায় ক্ষত হয়েছে। আর ইমরানের দুই হাতের মাংস ছিলে হাড় দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানের চামড়া উঠে গেছে। মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়ায় দাঁড়াতে পারছে না।
রফিকুল ইসলাম আরও জানান, আরোয়া এখন গাড়ি দেখলেই ভয় পাচ্ছে। মঙ্গলবার তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। সে গাড়িতে উঠতে চাচ্ছিল না। চিৎকার করে বলছিল, গাড়ি ধাক্কা দেবে। এক পর্যায়ে তার দাদি বুকে জড়িয়ে নিয়ে তাকে হাসপাতালে নেয়। যতক্ষণ গাড়িতে ছিল সে, কোনো দিকে তাকাইনি।
তাদের বাসা রাজধানীর মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডে। প্রকৌশলী ইমরান মিরপুরে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আর তাঁর স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রাক্তন ছাত্রী আফরোজা ওয়ান ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের প্রিন্সিপাল অফিসার। রোববার আরোয়াকে তার মা-বাবা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সেখান থেকে রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন তারা। বাসার সামনে আসার পর শিশু আরোয়া বায়না ধরে একটু ঘুরবে। এর পর বাসায় যাবে। রিকশায় ইকবাল রোডে মাঠের পাশে ঘুরছিলেন তারা। রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাসার ৪০ থেকে ৫০ গজ দূরে একটি বেপরোয়া গতির প্রাইভেটকার রিকশাকে ধাক্কা দেয়। এতে আহত হন ইমরান রেজা, আফরোজা আহমেদ, আরোয়া ও রিকশাচালক হাবিবুর রহমান। আরোয়া সামান্য আহত হওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় আছে দাদা-দাদির কাছে। গুরুতর আহত ইমরান-আফরোজা দম্পতিকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সোমবার দু’জনকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ওই ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাতে দেখা যায়, রিকশাটি মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আর বেপরোয়া গতির প্রাইভেটকার ইউটার্ন নিয়েই রিকশাটিকে ধাক্কা দিয়ে ফুটপাতে উঠে যায়। রিকশা থেকে ছিটকে পড়েন আরোহী ও চালক। গাড়িটি চালাচ্ছিল এক কিশোর। তার নাম শাহরিয়ার হাসান। গাড়িতে বসে ছিলেন সালমান হায়দার নামে এক যুবক। ঘটনাস্থল থেকে উপস্থিত জনতা তাদের আটক করে পুলিশে দেয়। এ ঘটনায় ইমরানের বাবা রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে শাহরিয়ার ও সালমানের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। শাহরিয়ার কিশোর হওয়ায় তাকে গাজীপুর টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র ও সালমানকে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাদী রফিকুলকে আসামির স্বজনরা হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই আবুল বাশার বলেন, সালমানের বাসা ইকবাল রোডে আর শাহরিয়ার থাকে শেরশাহ সুরি রোডে। প্রাইভেটকারটির মালিক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর। গাড়িটি তিনি সালমানদের তত্ত্বাবধানে রেখে গেছেন। সালমান বন্ধুদের নিয়ে সেটি মাঝে মধ্যে চালান। তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। রোববার তিনি সিটে বসেছিলেন আর গাড়িটি চালাতে দিয়েছিলেন শাহরিয়ারকে।
বকুল আহমেদ