বেনজীর পুঁজি ছাড়াই ভাওয়াল রিসোর্টের মালিক

0
69
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

শুধু ক্ষমতার জোরই ‘পুঁজি’। জনশ্রুতি রয়েছে, পাঁচতারকা মানের ভাওয়াল রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিক হতে এক পয়সাও লগ্নি করতে হয়নি সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদকে। গাজীপুরের বারইপাড়া মৌজার নীলজানি গ্রামে গড়ে তোলা এ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারটির ওয়েবসাইটে এর জমির পরিমাণ ৩৫ একর (১০৫ বিঘা) বলা হলেও এলাকাবাসীর দাবি, রিসোর্টের জায়গা ৫০ একরের কম না।

গাজীপুরের বন বিভাগের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, বনের প্রায় পৌনে ৭ একর জমি দখল করে রিসোর্টটি দাঁড় করানো হয়েছে। গতকাল শনিবার ভাওয়াল রিসোর্ট এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, পুলিশের শীর্ষ পদে থাকার সময় কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। কীভাবে প্রভাববলয় ব্যবহার করে এত সম্পদ অর্জন করেছেন, তা আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই গাজীপুরের রিসোর্টটির মালিক বনে গেছেন বেনজীর। শুরুতে ১৯ একর জমি নিয়ে রিসোর্টটির কাজ শুরু হলেও সাবেক আইজিপি (তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের-ডিএমপি কমিশনার) বেনজীরের ক্ষমতার জোরে প্রায় ৫০ একর জায়গা দখল করে নেন রিসোর্ট মালিকরা।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রভাবশালীদের কাছ থেকে রাজেন্দ্র ইকো রিসোর্ট, ম্যাক্স ভ্যালিসহ সাতটি রিসোর্টের অবৈধ দখল করা জমি উদ্ধার করলেও ভাওয়াল রিসোর্টের জমি উদ্ধারে এতদিন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছিল না বন বিভাগ। এ বিষয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, ভাওয়াল রিসোর্টের করা এক মামলায় এ জমির বিষয়ে একটি স্টে অর্ডার ছিল। এ কারণে বন বিভাগ চাইলেও জেলা প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তবে ২০১৭ সালেই জেলা জজ আদালতের স্টে অর্ডারের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ যৌথভাবে আপিল করে। গত বৃহস্পতিবার এর রায় হয়েছে। আদালত আপিলটি গ্রহণ করে স্টে অর্ডারটি প্রত্যাহার ও ভাওয়াল রিসোর্টের মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে এখন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় কোনো বাধা নেই। তবে প্রক্রিয়া শুরু করতে কয়েক দিন লাগতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের গাজীপুরের এক কর্মী জানান, রাজেন্দ্র ইকো রিসোর্টের মালিকানায় সাবেক অতিরিক্ত আইজি বজলুল করিম, মেজর কবিরসহ বহু পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তার পরও বন বিভাগ দখলে থাকা জমি উদ্ধার করেছে। ম্যাক্স ভ্যালির মালিকানায় আছে একটি নামকরা টিভি চ্যানেলের। বন বিভাগ তাদের থেকেও অবৈধ দখলকৃত জমি উদ্ধার করেছে। কিন্তু এ জায়গায় (ভাওয়াল রিসোর্টে) এসে হোঁচট খাচ্ছিলাম। প্রকৃতপক্ষে বন বিভাগের কতটা জমি দখল করে রেখেছে, তা পরিমাপের জন্য বন বিভাগ বা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কেউ এ রিসোর্টটিতে প্রবেশ করতে পারছিল না। আদালতের রায় পক্ষে আসায় এখন কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা করছি।

শুধু বন বিভাগ নয়, বীর মুক্তিযোদ্ধার জমিও দখল করে করা হয়েছে ভাওয়াল রিসোর্ট। এর মূল প্রবেশপথের এক একরের বেশি জমি কাপাসিয়া-শ্রীপুরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডা. সিরাজুল হক এবং তাঁর মায়ের। প্রবীণ এ মুক্তিযোদ্ধা নিজের জমি উদ্ধারে নানাজনের কাছে দিয়েছেন ধরনা। তবে প্রভাবশালী বেনজীরের কারণে তারা ২০১৩ সালের পর থেকে ওই জমির ধারেকাছেও ভিড়তে পারেননি। বেনজীরের অনিয়ম-দুর্নীতির খবর চাউর হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছেন ডা. সিরাজুল। জমি থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে গাজীপুর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি।

এলাকাবাসী জানান, ভাওয়াল রিসোর্টের মূল উদ্যোক্তা দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প গ্রুপ পারটেক্স। ব্যবসায়িক গ্রুপটির উদ্যোক্তা প্রয়াত এম এ হাশেমের ছেলে শওকত আজীজ রাসেল বর্তমানে এটির মালিকানায় রয়েছেন। ২০১৩ সালে গাজীপুর সদরের বারইপাড়া মৌজার নীলজানি গ্রামের কয়েকজনের ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি কিনে এর সঙ্গে আরও কিছু সরকারি খাসজমি দখল করে নেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকাবাসী জানান, ভাওয়াল রিসোর্টটির মালিক পক্ষ ২০১০ সাল থেকে এ এলাকার জমি কেনা শুরু করে। তৎকালীন গাজীপুরের এসপি (বর্তমানে রংপুর রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি) আব্দুল বাতেন ভাওয়াল রিসোর্টের পক্ষে কাজ করেছেন। জমি দখল থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতা প্রদর্শনে সব সহায়তা দেন বলে জানান তারা। তবে গতকাল সন্ধ্যায় যোগাযোগ করলে ডিআইজি আব্দুল বাতেন এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘এখন নানাজন নানা কথা বলবে। প্রকৃতপক্ষে আমার ভাই আব্দুর রাজ্জাকের (সোনালী ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা) ভাওয়াল রিসোর্টের সঙ্গে কয়েক বিঘা জমি ছিল। সেই সূত্রে আমি একবার ওই এলাকায় গিয়েছিলাম। ভাওয়াল রিসোর্টের সঙ্গে কখনোই আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না।’

তবে স্থানীয় বাসিন্দা মো. বাদল মিয়া জানান, এসপি বাতেন এ জমি কেনাবেচায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে কখনও শুনিনি। ভাওয়াল রিসোর্টের মূল জমিটির মালিক ছিলেন তিন ভাই– রাধা বলম, গোপী বলম ও চাঁদ বলম। তারা ভারতে চলে গেছেন। তাদের কাছ থেকে আমির উদ্দিন ও দত্তর মুন্সী জমি কিনে নিয়েছিলেন। তবে বাঘের বাজারের হাবিবুর রহমান নামে একজন মিথ্যা দলিল করে জমি দখল করে নেন। স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে মীমাংসা হওয়ার পর আমির উদ্দিন ও দত্তর মুন্সীদের কাছ থেকে জমি কিনে নিয়েছিলেন রাজউক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল মঞ্জুর আলম। এক ছাত্রের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে এ জমি কিনেছিলেন তিনি। এর পর মঞ্জুর আলমের কাছ থেকে পারটেক্স গ্রুপ জমি কিনে নেয়। পরে রফিক মাস্টারসহ অনেকে জমি বিক্রি করেছেন। এখানে বেনজীর  আহমেদের কোনো জমি ছিল না। শুনেছি, এই রিসোর্টের মালিকানায় তিনিও আছেন। তবে কীভাবে মালিক হয়েছেন, তা জানি না। ভাওয়াল রিসোর্ট তাদের দখলে থাকা জমির পরিমাণ ৩৫ একর দাবি করলেও বাদল মিয়ার দাবি, এর পরিমাণ ৫০-৬০ বিঘার বেশি হবে না।

তবে স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষক রাজ্জাক জানান, তিনি সরাসরি ভাওয়াল রিসোর্টের কাছে জমি বিক্রি করেননি। তিনি জমি বিক্রি করেছেন রাজউক স্কুল অ্যান্ড কলেজের মঞ্জুর আলমের কাছে। ভাওয়াল রিসোর্টের পক্ষে জমির দালালি ও দখলে কাজ করেছেন– স্থানীয় কয়েকজনের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ঠিক না।

এলাকাবাসী জানান, তৎকালীন এসপি বাতেনের পর ২০১৭ সালে হঠাৎ ভাওয়াল রিসোর্টের সঙ্গে যুক্ত হন বেনজীর। ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু জমির দখল ছাড়তে রাসেলদের চাপ প্রয়োগ করেন তিনি। এক পর্যায়ে বেনজীরকে এর অংশীদার করে দিয়ে আপসরফা করে নেন রাসেল।

এ ব্যাপারে কথা বলতে বেনজীর আহমেদের মোবাইলে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে ভাওয়াল রিসোর্টের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এম্বার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং রিসোর্টির মালিক শওকত আজীজ রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগেরও চেষ্টা করা হয়।

ভাওয়াল রিসোর্টের মূল প্রবেশপথের জমিটি মুক্তিযোদ্ধা ডা. সিরাজুল হক ও তাঁর মায়ের জমি দখল করে গড়ে তোলা। এ ব্যাপারে ডা. সিরাজুল হকের ভাই বজলুল হক জানান, ভাইয়ের জমি উদ্ধারে আজ রোববার গাজীপুর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালে এই জমি কেনা। স্থানীয় বাসিন্দা মো. শফিউল্লাহর কাছে জমিটি বর্গা দেওয়া ছিল। ২০১৩ সালে হঠাৎ জমিটি দখল করে নেয় ভাওয়াল রিসোর্ট। পরে জানতে পারি, এর সঙ্গে পুলিশের বড় কর্তারা জড়িত। ফলে ভয়ে আমরা ওই জমির ধারেকাছেও জেতে পারিনি। এখন বেনজীরের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে দেখে আমরাও কিছুটা সাহস পাচ্ছি।

শফিউল্লাহর কাছে জমি দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ডা. সিরাজুল হকদের জমিটি একসময় নিচু ছিল। আমিই বর্গা নিয়ে চাষ করতাম। ভাওয়াল রিসোর্টের লোকজন জমি ভরাট করে এখানে রিসোর্ট বানায়। এক পর্যায়ে রাস্তায় ওঠার জন্য তাদের জমি ছিল না। তখন এ জমিটি দখল করে নেয়। তারা জানত, এটা এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের জমি। তার পরও তারা তা গ্রাহ্য করেনি। সিরাজুল হক জমির আশপাশেও যেতে পারতেন না। নানা জনের কাছে ধরনা দিয়ে জমি উদ্ধার করতে না পেরে ন্যায্যমূল্যে তা কিনে নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। সেই অনুরোধ রিসোর্টের মালিকরা রাখেননি। তবে প্রতিবছর এ জমির সরকারি খাজনা আমি দিয়ে এসেছি। ১৪৩১ বাংলা সনের খাজনাও আমি দিয়েছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকাবাসী জানান, ২০১৭ সালে ভাওয়াল রিসোর্টের অধীনে সব মিলে জমি ছিল ১৯ একর। বেনজীর যুক্ত হওয়ার পর আশপাশের আরও জমি জবরদখল করে এর আয়তন বাড়িয়ে নেন। এখন রিসোর্টের অধীনে জমির পরিমাণ ৫০ একরের কম হবে না। এলাকাবাসী আরও জানান, এলাকায় বেনজীর যখন আসতেন, তখন মেম্বারবাড়ি, নলজানি রাইস মিলসহ পুরো এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হতো। ভয়ে তখন কেউ রাস্তায় উঠত না। এর পর যাদের জমি দখল করা হয়েছিল, তারাও ভয়ে ওই এলাকায় যেতেন না।

দুদকের চিঠি বাড়ির অভ্যর্থনা কক্ষে

অবৈধ সম্পদ অর্জনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ২৮ মে বেনজীর আহমেদকে চিঠি দেয় দুদক। ৬ জুন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ৯ জুন জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তলব করা হয়েছে। তবে দুদকের ওই চিঠি গুলশান-১ এর ১২৬ নম্বর সড়কে বেনজীরের বাসার অভ্যর্থনা কক্ষে পড়ে আছে। দুদকের চিঠি ওই বাড়িতে পৌঁছার আগেই ৪ মে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দেশ ছাড়েন সাবেক আইজিপি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.