স্বজনেরা কেউ না আসায় নিরাশ চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার আসামি মোহাম্মদ রনি। হাজতখানার লোহার শিকল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পকেটে নেই টাকা। কিছুক্ষণ পরপর পায়চারি করছেন হাজতখানার ভেতরে। ক্ষুধায় জ্বলছে পেট। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুইটা। হাজতখানার দায়িত্বরত ওসি সাদা প্যাকেট নিয়ে ঢুকছেন সেখানে। তারপর একে একে আসামিদের হাতে তুলে দেন প্যাকেটগুলো। সাদা প্যাকেটের ভেতর খিচুড়ি ও ডিম, সঙ্গে পানি। হাতে দিতে না দিতেই খাওয়া শুরু করেন রনি। তাঁর চোখেমুখে তৃপ্তির ঝিলিক। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের নিচতলায় মহানগর হাজতখানায় দেখা গেছে এই চিত্র।
পেশায় রংমিস্ত্রি রনি বলেন, ছিনতাইয়ের মামলায় গ্রেপ্তার হন। সকাল থেকে কিছুই খাননি। খিদে লাগায় অস্থির হয়ে পড়েন। এর আগেও গ্রেপ্তার হয়ে আদালতের হাজতখানায় এসেছিলেন। তখন খাবার পাননি। এবার খাবার পেয়ে অনেক খুশি তিনি।
শুধু রনি নন, আজ মহানগর হাজতখানায় ৬০ আসামিকে দুপুরের খাবার দেওয়া হয় বেলা আড়াইটা পর্যন্ত। এত দিন আসামিরা সরকারি বরাদ্দের কোনো খাবার পেতেন না। বেশির ভাগই উপোস থাকতেন। যাঁদের স্বজনেরা আসতেন, তাঁরা পুলিশকে টাকা দিয়ে তাঁদের খাবার দিতেন।
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. আবদুর রশিদ বলেন, বিষয়টি এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। একজন আসামির স্বজন তাঁকে খাবার পাওয়ার বিষয়টি জানান। এরপর নিজে হাজতখানায় এসে দেখেন আসামিরা খাবার খাচ্ছেন। আদালতের হাজতখানার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আসামিরা খাবার পেয়েছেন দেখে খুশি এই সরকারি কৌঁসুলিও।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর হাজতখানায় এখন আসামিদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। তবে আজই প্রথম দুপুরের খাবার দেওয়া হলো। দেরিতে হলেও পুলিশের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সরকারি কৌঁসুলি মো. আবদুর রশিদ বলেন, এটি যাতে আর বন্ধ না হয়। আর এত দিন যাঁরা সরকারি বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেছেন, সেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
জানতে চাইলে নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে প্রতিবেদন পেলে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আজ দুপুরে মহানগর হাজতখানার সামনে গিয়ে দেখা যায়, খাবারের প্যাকেট পেয়ে খুশি আসামিরা। আগে আদালতে এলে দুপুরের খাবার নিয়ে ভাবতে হতো। এমন সুবিধা আছে তা জানতেন না অনেক আসামি।
হাজতখানার বাইরেও আসামিদের স্বজনেরাও বিষয়টি নিয়ে খুশি। এত দিন পুলিশ সদস্যদের টাকা দিয়ে স্বজনদের নাশতা ও খাবার দিতে হতো। এখন আর তা করতে হচ্ছে না। সরকারি বরাদ্দের টাকা থেকে আসামিরা খাবার পাওয়ায় তাঁরা খুশি। হাজতখানার বাইরে দাঁড়ানো নগরের চান্দগাঁও থেকে আসা নূপুর আক্তার বলেন, আগে পুলিশকে টাকা দিয়ে তাঁর ভাইকে খাবার দিতেন। আজ পুলিশই হাজতখানায় তাঁর ভাইকে খাবার দিয়েছে। এতে অনেক খুশি নূপুর।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) আরাফাতুল ইসলাম বলেন, আসামিদের দুপুরের খাবার হিসেবে ডিম, খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সাদা ভাত, মাছ কিংবা মাংস দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
মহানগর হাজতখানার ইনচার্জ রফিক উল্লাহ জানান, প্রতিদিন বেলা একটা থেকে খাবার দেওয়া শুরু হয়। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত যতক্ষণ থানা থেকে আসামি আদালতের হাজতখানায় আসেন খাবার দেওয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত শনিবার ‘আসামির খাবারের টাকা পুলিশের পকেটে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, গত আড়াই বছরে আসামিদের দুপুরের খাবার বাবদ সরকারি কোষাগার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। বাস্তবে খাবার দেওয়া হতো না। উল্টো পুলিশকে টাকা দিয়ে খাবার খেতে হতো।