বিশ্রাম পান না চালক, দুর্ঘটনা কাড়ে জীবন

0
180
শরীয়তপুরের জাজিরায় মঙ্গলবার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রিয়জন হারিয়ে স্বজনদের আহাজারি

সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালার ৩২(৫) ধারায় গণপরিবহনের চালকের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২৭ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়া এই বিধিমালায় বলা হয়, একজন চালককে দিয়ে একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো যাবে না। এর পর কমপক্ষে আধা ঘণ্টা বিশ্রাম দিয়ে আবার তিন ঘণ্টা গাড়ি চালানো যাবে। তবে দিনে আট ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি একজন চালককে দিয়ে গাড়ি চালানো যাবে না।

এ নিয়ম মানতে হবে মালিককে। কিন্তু তা মানা হয় না। বিশ্রামহীন ড্রাইভিংয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে শরীয়তপুরে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার আগে ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কায় যে অ্যাম্বুলেন্সের (ঢাকা মেট্রো-ছ-৭১-৩৪৮২) ছয় জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে, তার চালক ২৬ ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।

যদিও অ্যাম্বুলেন্সের মালিক মো. নূর আলমের দাবি, অভিযোগটি সঠিক নয়। তিনি জানিয়েছেন, সোমবার রাত ১২টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সটি বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে। এর ঘণ্টা চারেক পর দুর্ঘটনা ঘটে।

তবে এর আগে রোববার রাত ১১টায় ঢাকা থেকে রওনা করে পরদিন দুপুর ১২টায় ভোলায় পৌঁছে অ্যাম্বুলেন্স। সেখান থেকে দুপুর ২টায় ফেরে বরিশালে। দিনে আট ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানোর নিয়ম থাকলেও, প্রায় ১৫ ঘণ্টা গাড়ি চালান চালক রবিউল ইসলাম। তবে মালিকের বক্তব্য, দুপুর ২টার পর থেকে বিশ্রামে ছিলেন চালক শ্রমিক। তাঁর ভাষ্য, কোথাও আট ঘণ্টা নিয়ম মেনে চালক নিয়োগ দেওয়া হয় না। তা সম্ভবও নয়।

মালিকরা খরচ বাঁচাতে চালককে দিয়ে একটানা গাড়ি চালালেও, এতে অপচয় হচ্ছে জীবনের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছেন, চালকদের বিশ্রাম দিতে হবে। তাঁদের ক্ষুধা ও ঘুম রয়েছে। কিন্তু চালক সংকটের অজুহাতে মালিকরা তা মানছেন না। পণ্যবাহী যানবাহনের চালকদের জন্য চারটি মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ প্রকল্পটি ছয় বছরেও সম্পন্ন হয়নি। দূরপাল্লার বাসে একাধিক চালক রাখার নিয়মও মানা হয় না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হলো, চার ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর চালক বিশ্রাম নেবেন। কিন্তু তা মানা হয়। টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালাতে বাংলাদেশে যে নিয়ম করা হয়েছে, তা কার্যকর হলে দুর্ঘটনা কমবে। দীর্ঘ সময় গাড়ি চালালে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসা, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়া, ঘুমিয়ে পড়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ঘুমে চোখ লেগে এলে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ব্যবধানে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, টানা ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা গাড়ি চালাচ্ছেন চালকরা। এমন শত শত উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে ঈদের সময় চালকরা বিশ্রাম বলে কিছুই পান না। ঢাকা থেকে যে চালক যানজট ঠেলে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টায় গন্তব্যে যাচ্ছেন, দ্রুত ফিরতি ট্রিপ ধরতে সেই চালককে দিয়ে বাস ফের ঢাকায় আনা হয়।

একাধিক চালক জানান, ঘুম কাটাতে তাঁরা নেশা করেন। চালক নিয়োগ এবং লাইসেন্স পেতে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। একাধিক চালক জানিয়েছেন, রাতভর গাড়ি চালানোর পর ভোরে আলোর পরিবর্তনের কারণে ঘুম পায়। তখন চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হয়। তারপরও গাড়ি চালাতে হয়।

সড়ক পরিবহনের ১৩ এবং ১৪ ধারা অনুযায়ী, চালক ও শ্রমিককে নিয়োগপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক। বেতন দিতে হবে মাসিক হিসেবে। তবে একাধিক চালক জানান, অধিকাংশ পরিবহনে মাসিক মজুরি দেওয়া হয় না। ট্রিপ অনুযায়ী টাকা দেওয়া হয়। বাড়তি আয়ের আশায় চালকরাও ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি চালানোর ঝুঁকি নেন। এতে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়েন।

তবে মালিকরা বলছেন, পর্যাপ্ত সংখ্যক চালক না থাকায় বাড়তি চালক নিয়োগ করা যায় না। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেছেন, দক্ষ চালকের সংকট রয়েছে। গাড়ির চেয়ে চালক কম। গাড়িতে বাড়তি রাখার মতো চালক কোথায়?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.