তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ের মাটি অম্লীয়। এ ধরনের মাটির ওপরের অংশ পাতলা, নিচের অংশে থাকে কংকর বা ছোট ছোট পাথর ও বালু। বেলে ও দো-আঁশ শ্রেণির এই মাটি সাধারণত নরম হয়। স্মরণকালের খরতাপে এই মাটি এখন ঝুরঝুরে হয়ে আছে। টানা বৃষ্টির পানি পেলে মাটির ওপরের স্তর ধুয়ে বড় ধরনের পাহাড় ধস হতে পারে। বর্ষায় চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলার কিছু পাহাড়ে এমন ধসে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় সাড়ে ২১ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে। চট্টগ্রামের ১৮ পাহাড়ে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বসতি আছে অর্ধলাখ। উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় লঘুচাপের প্রভাবে পাহাড়েও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। টানা ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসের শঙ্কা বেড়ে যাবে। টানা ভারী বৃষ্টির কারণে ২০১৭ সালের ১৩ জুন চট্টগ্রাম, তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারে প্রাণ গেছে ১৬৮ জনের। ভয়াবহ সেই বিপর্যয়ে রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর যুব উন্নয়ন বোর্ড এলাকা, মুসলিমপাড়া, শিমুলতলী, রূপনগর, সাপছড়ি, মগবান, বালুখালী এলাকায় এবং জুরাছড়ি, কাপ্তাই, কাউখালী ও বিলাইছড়ি উপজেলায় পাঁচ সেনাসদস্যসহ ১২০ জনের মৃত্যু হয়। চট্টগ্রামের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় প্রাণ হারান ১২ জন। এতে রাঙামাটির ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সারাদেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ এক সপ্তাহ বিচ্ছিন্ন ছিল। ভয়াবহ এই পাহাড় ধসের পর পুনর্বাসন দূরের কথা, বরং পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আরও নতুন ঘরবাড়ি উঠেছে।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের ২৯ স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া নানিয়ারচর, কাউখালীসহ কয়েকটি উপজেলায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ১৫ হাজারের বেশি পরিবার বাস করছে। বান্দরবানে পাহাড়ের পাদদেশে দুই হাজারের বেশি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে। খাগড়াছড়ির প্রায় চার হাজারের ওপরে পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাস করছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন, অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ এবং বন-জঙ্গল ও গাছ উজাড়ের কারণেই পার্বত্য অঞ্চলে একের পর এক পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। ২০১৭ সালে ভয়াবহ পাহাড় ধসের পর একাধিক মন্ত্রণালয়ের কমিটি বিভিন্ন সুপারিশ করে। এসবের মধ্যে রয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী ছিন্নমূল মানুষের জন্য স্থায়ী আবাসন নির্মাণে জায়গা নির্ধারণ, রাঙামাটিতে আশ্রয়হীন এবং যারা পাহাড়ের পাদদেশে বাস করছে, তাদের জন্য সরকারি অর্থায়নে স্থায়ীভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ, পাহাড়ের পাদদেশে ঘরবাড়ি নির্মাণ বন্ধ, পাহাড়ে পরিবেশবান্ধব এবং পাহাড় রক্ষাকারী বৃক্ষ ও বাঁশ রোপণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, পাহাড় থেকে মাটি কেটে ও ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ইত্যাদি। এসব সুপারিশ কাগজে থাকলেও এখনও দৃশ্যমান বাস্তবায়িত হয়নি। তবে প্রতিবছর বর্ষা এলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সাইনবোর্ড ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করে থাকে।
রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সুপ্রিয় চাকমা বলেন, গাছপালা ধ্বংস, নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। কারণ পাহাড়ে ঘরবাড়ি তৈরি করতে একটি স্তর থাকে। তবে মাটির যে স্তর আছে বেশি পাহাড় কাটা হলে তাতে পাহাড় ধসের শঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, একনাগাড়ে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসের ঝুঁকি রয়েছে।
মৃত্তিকাসম্পদ ইনস্টিটিউট রাঙামাটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি করা ছাড়াও পাহাড় কেটে আনারস, আদা, হুলুদ ও কচু চাষ করা হচ্ছে। এতে পাহাড়ে ভূমিধসের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
পাহাড় ধসের পর ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি স্থাপন করা ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের কথা বলে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। এটি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে স্থায়ী পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি তারা। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘পাহাড় ধসে প্রতিবছর প্রাণ হারায় মানুষ। স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য আমরা কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েছি। তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।’
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যে রাঙামাটি পৌর এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২২টি আশ্রয়কেন্দ্র।