বিদেশি ঋণ পারিশোধে বাংলাদেশ খেলাপি হয়নি– এই গর্বের জায়গা ফুরিয়ে আসছে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, কয়েক মাস ধরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
মঙ্গলবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজনে রাজধানীর নয়াপল্টনে সংগঠনের কার্যালয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন স্মারক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। ইআরএফ সম্পাদক আবুল কাশেমের পরিচালনায় ও সংগঠনের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, এখন দেখা যাচ্ছে, জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। এতদিন আমরা বলেছি, প্রবৃদ্ধির গতি সুতাকাটা ঘুড়ি। কারণ নাটাইয়ের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতির কোনো সম্পর্ক নেই। বিনিয়োগ, ঋণ, আমদানির সঙ্গে সম্পর্ক নেই, কিন্তু প্রবৃদ্ধি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘অনেক আগেই বলেছিলাম, বর্তমান উন্নয়ন ধারায় চারটি ঘাটতি হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে শুধু সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে। অর্থাৎ এটি এক ইঞ্জিনের বোয়িং। দ্বিতীয় ইঞ্জিন বা বেসরকারি খাত স্তব্ধ হয়ে আছে। প্রবৃদ্ধি থেকে কোনো কর আসছে না; কর জিডিপি অনুপাত বাড়ছে না। প্রবৃদ্ধি থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি কোনো বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া অতি মূল্যায়িত বিভিন্ন প্রকল্প বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে যাবে।’
তিনি উল্লেখ করেন, কয়েক বছর আগেই বলেছিলেন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ বিদেশি ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধে চাপের মুখে পড়বে। এটা শুধু সরকার নয়, বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ সমস্যা ২০২৬ সালে আরও প্রকট হবে। অনেকেই বলেন, গর্বের জায়গা হচ্ছে– বাংলাদেশ বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে খেলাপি হয়নি। কিন্তু কয়েক মাস হয়ে গেলেও ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। জ্বালানি তেল আমদানির বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না; বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুনাফার টাকা নিয়ে যেতে পারছে না। এমনকি বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোও টাকা নিয়ে যেতে পারছে না। সরকারের সে গর্বের জায়গা ফুরিয়ে যাচ্ছে। এসব তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া যেত। কিন্তু সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধে আরও দুই বছর সময় চাওয়া হয়েছে। এ রকম ঘটনা আরও ঘটবে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের রিশিডিউল করতে হলে এখনই একটি পরিকল্পনা দরকার। এসব ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা এবং জাপান, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে একটি পথনকশা তৈরি করা দরকার।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে উত্তরণ করছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃসংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ডিজিটাল বা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক। এটা পদ্ধতিগত ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উভয়ভাবেই সাংঘর্ষিক। যখন সমাজে গণতন্ত্র চর্চা বন্ধ হয়ে যায়, গণমানুষের প্রতিনিধিদের ভূমিকা কমে যায় এবং উর্দি পরা, উর্দি ছাড়া আমলাদের প্রভাব বেড়ে গেলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কারণ উনাদের শিক্ষাটাই এমন, উনারা জনগণের সঙ্গে জবাবদিহি করতে চান না।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমরা সংসদ সদস্যদের সঙ্গে কাজ করে জানতে পেরেছি, বাজেটে বরাদ্দকৃত টাকা কোন খাতে কত খরচ হবে– এ তথ্য জানার অধিকারও তাদের দেওয়া হয়নি। নিজস্ব এলাকায় কোন খাতে কী পরিমাণ টাকা খরচ হয়, সেটাও সংসদ সদস্যরা জানতে পারেন না! তারা জনপ্রতিনিধি হয়েও এ তথ্য জানার প্রাধিকার পান না। সাংবাদিকদের চেয়ে তাদের দুঃখ কম নয়। এমপিদের নিজেদের মনে দুর্বলতা থাকায় তারাও আমলাদের সঙ্গে বড় গলায় কথা বলতে পারেন না। এতে ক্ষতি হচ্ছে দেশের মানুষের।
তিনি বলেন, একটা বাস্তবতা হচ্ছে পদ্মা সেতু, টানেল, ফ্লাইওভার হয়েছে। আরেকটা বাস্তবতা হচ্ছে বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়নি, নারী নির্যাতন বেড়ে গেছে, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। সঞ্চয় ভেঙেও জনগণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পারছে না। খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিরা নন, তথ্য পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকরা তথ্য পাচ্ছেন না; কিন্তু গুটিকয়েক ব্যবসায়ী পাচ্ছেন। তারাই ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব ব্যবসায়ীকে আগাম তথ্য দেওয়া হলে বাজারে প্রভাব পড়ে; সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো সহজ হয়। এভাবেই কিছু মানুষকে আগাম তথ্য দিয়ে দেশের পুঁজিবাজার নষ্ট করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আগে দেশে তথ্য-উপাত্তের নৈরাজ্য ছিল, এর পর শুরু হয় অন্ধত্ব। এখন দেখা যাচ্ছে, তথ্য-উপাত্তের অপঘাত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে সম্প্রতি যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, এটা তারই প্রমাণ।
তথ্যের অপঘাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনামের হানি হচ্ছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, ‘তথ্য-উপাত্তের বড় উৎস বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের আগে রপ্তানি-আমদানিসহ আর্থিক সূচকের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম আমরা।’
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, এটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। অথচ সাংবাদিকদের সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তাঁর প্রশ্ন, তথ্য প্রকাশিত হলে কি বড় ধরনের নাশকতা হবে? অর্থনৈতিক সাংবাদিকরা কি নাশকতাকারী?
দুই দশকে প্রকৃত বাজেটের আকার বাড়েনি
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী বাজেট দেওয়ার পরও হয়তো বলা হবে সর্বকালের বড় বাজেট দেওয়া হলো। অথচ প্রতি বছর সংশোধন করে মূল বাজেটের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমানো হয়। এর মধ্যে আবার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়। অর্থাৎ প্রকৃত বাজেটের আয়তন গত দুই দশকে সে অর্থে বাড়েনি। এ কথা কেউ বলে না। জিডিপির তুলনায় আরও বড় বাজেট দেওয়া প্রয়োজন। এর পরও যে বাজেট দেওয়া হয়, সেখানে হিসাব মেলানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অলৌকিক লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা তারা কোনো দিন অর্জন করতে পারে না। সরকারি ব্যয়ে দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে জনগণও কর দিতে উৎসাহী হয় না। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা না থাকলে মানুষ কর দিতে চায় না। বাংলাদেশে একটি বালিশ পাঁচ তলায় তুলতে সরকারের কয়েক হাজার টাকা ব্যয় হয়।
এসব কারণেই কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ছে না। তা ছাড়া জিডিপি পরিগণনায়ও গলদ রয়েছে। সরকারের দায়-দেনা আনুপাতিক হারে কম দেখানোর জন্য জিডিপির আকার বড় করা হয়েছে। আর এ জন্যও করের অনুপাত কম দেখানো হচ্ছে। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে খেললে এ রকম বিপরীতমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়।
আগামী বাজেটে যেসব খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে এখন তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলো হলো– অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি, ঝুঁকিপূর্ণ ক্রমবর্ধমান দায়-দেনা পরিস্থিতি এবং শ্লথ অর্থনীতি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি আসন্ন বাজেটে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ ও আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় আগামীতে ভর্তুকি, করছাড় ও রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমিয়ে আনতে হবে। এসব কাজ খুবই দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জনগণের প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে করা উচিত। অর্থাৎ বড় শিল্পে করছাড় কমিয়ে আনা হলেও ক্ষুদ্র, মাঝারি ও গ্রামীণ শিল্পকে আগামী বাজেটেও তাদের সুরক্ষা দেওয়া উচিত। করের আওতা সম্প্রসারণ, রাজস্ব আদায়ে অটোমেশনের পাশাপাশি সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
এবার ফসল ভালো হয়েছে। তবে সরকারের মজুত বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। খোলাবাজারে সরকারের ওএমএস এবং টিসিবির কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়াতে মুদ্রা বিনিময় হার নমনীয় করে ক্রমান্বয়ে বাজারভিত্তিক করতে হবে। হুন্ডি বন্ধ ও অর্থ পাচার রোধ করতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রকৃত সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতি সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে।