বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে সৈয়দ আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়ার পরিবার

0
80
শিমুল ভূঁইয়া

খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়নের দামোদর গ্রামে পাশাপাশি নতুন তিনটি পাকা ডুপ্লেক্স বাড়ি। তিনটি বাড়িরই নির্মাণকাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। রং করা হয়নি। প্লাস্টারের কাজও বাকি রয়েছে কোনো কোনো জায়গায়। প্রধান ফটক ও নকশায় আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ওই তিনটি বাড়ির মালিক খুলনার শীর্ষ চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া, তাঁর ছোট ভাই শরীফ মুহাম্মদ ভূঁইয়া (শিপলু) ও বড় ভাই হানিফ মুহাম্মদ ভূঁইয়া। এর মধ্যে শিপলু ভূঁইয়া দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। শিমুল ভূঁইয়ার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন (মুক্তা) খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বাড়ি তিনটি একেবারে ফাঁকা। ওই তিন পরিবারের সদস্যরা কোথায় গেছেন, তা আশপাশের কেউ বলতে পারছেন না। তাঁদের ব্যাপারে এলাকাবাসীও কিছু বলতে ভয় পাচ্ছেন। তবে তাঁদের ভাষ্য, শিমুল ভূঁইয়ার বাড়িতে তাঁর স্ত্রী সাবিনা ও তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়ে থাকতেন। তবে ১৫ বছরের মধ্যে শিমুল ভূঁইয়াকে ওই এলাকায় কেউ দেখেননি।

কলকাতার নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীমকে (আনার) খুনে ভাড়া করা হয় খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়াকে। তিনি চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা অঞ্চলের প্রধান। আনোয়ারুল খুনের ঘটনায় ঢাকায় ধরা পড়ার পর পুলিশের কাছে শিমুল ভূঁইয়া নিজেকে সৈয়দ আমানুল্লাহ নামে পরিচয় দিয়েছেন। এই খুনের ঘটনায় শিমুল ভূঁইয়ার বড় ভাই হানিফের ছেলে তানভীর ভূঁইয়াকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

উল্লিখিত তিনটি নতুন ডুপ্লেক্স বাড়ির পাশেই রয়েছে শিমুলের আরেক ভাই মোস্তাক মুহাম্মদ বকুল ভূঁইয়ার বাড়ি। এই বাড়িও দোতলা, তবে একটু পুরোনো। এই বাড়িতে গিয়ে বকুল ভূঁইয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পাওয়া গেল। মোস্তাক মোহাম্মদ বকুল ভূঁইয়া বলেন, ১৫-২০ বছর ধরে তাঁর ছোট ভাই শিমুল ভূঁইয়া এলাকায় আসেন না। তাঁরা জানেন, শিমুল কয়লার ব্যবসা করেন। কীভাবে ওই খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত হলেন তা বুঝতে পারছেন না।

শিমুল ভূঁইয়ার বাড়ির প্রধান ফটকে তালা দেওয়া। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ওই বাড়িতে কেউ নেই বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী

শিমুল ভূঁইয়ারা পাঁচ ভাই। সবার বড় হানিফ। এরপর বকুল, মুকুল, শিমুল এবং শিপলু। ২০১১ সালে তৃতীয় ভাই মুকুল ভূঁইয়া ওরফে হাতকাটা মুকুল পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

শিমুল ভূঁইয়ার ছোট ভাই দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান শরীফ মুহাম্মদ ওরফে শিপলু ভূঁইয়ার মুঠোফোনে কল করলে তিনি বলেন, তাঁরা কেউ বাড়িতে নেই। কোথায় গেছেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোনো জবাব দেননি। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সৈয়দ আমানুল্লাহ তাঁর ভাই কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনেছি আমানুল্লাহ নামের একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তবে তিনি আমার ভাই কি না, তা জানি না।’

২০১৬ সালের দিকে খুলনার চরমপন্থী নেতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একটি তালিকা করে গোয়েন্দা সংস্থা। সেই তালিকায় ৩ নম্বরে ছিল শিপলু ভূঁইয়ার নাম। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ প্রায় এক ডজন মামলা রয়েছে। একটি মামলায় তাঁর ৩২ বছরের সাজাও হয়েছিল। শিপলুর বড় ভাই শিমুল ভূঁইয়ার নাম ছিল ওই তালিকার ৪ নম্বরে। শিমুল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) আঞ্চলিক নেতা হিসেবে ওই তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল। তালিকায় তাঁকে পলাতক হিসেবে দেখানো হয়।

শিমুল ভূঁইয়া পলাতক থাকলেও তাঁর বিরুদ্ধে খুলনা অঞ্চলের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ ছিল বহুদিন থেকে। গত চার বছরে ফুলতলা ও ডুমুরিয়ায় এলাকায় অন্তত তিনটি হত্যা মামলার সঙ্গে তাঁর নাম সরাসরি জড়িয়ে আছে। এ পর্যন্ত ২৫টি মামলার সঙ্গে শিমুল ভূঁইয়ার নাম জড়িয়ে আছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

শিমুল ভুঁইয়ার ছোট ভাই দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান শিপলু ভূঁইয়ার বাড়িতেও কেউ নেই। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে তোলা

২০১৭ সালের ২৫ মে সন্ধ্যার পর নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে খুন হন ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দিন (মিঠু)। তাঁর ছোট ভাই রাজ সরদার হত্যা মামলা করেন। ওই ঘটনায় ২০১৮ সালে শিমুলকে প্রধান ও তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনকে ৪ নম্বর আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। বাদী নারাজি দিলে আদালত তদন্তভার পিবিআইকে দেন। ২০২২ সালের ১০ মে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পিবিআই। এতে শিমুল প্রধান আসামি থাকলেও সাবিনা ইয়াসমিনকে করা হয় ৭ নম্বর আসামি। পলাতক থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেন আদালত। পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন সাবিনা ইয়াসমিন।

স্থানীয় লোকজন ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিমুল ভূঁইয়া ১৯৮৫ সালে দামোদর এমএম উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর খুলনার দৌলতপুরের দিবা-নৈশ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে স্নাতকে ভর্তি হন রাজশাহী বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। রাজশাহীতে থাকাকালে শিমুলের যাতায়াত ছিল ঝিনাইদহে। সেখানে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-লাল পতাকা) শীর্ষ নেতা আব্দুর রশিদ মালিথা ওরফে দাদা তপনের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। একাধিকবার জেল খাটার কারণে লেখাপড়া বন্ধ করে চরমপন্থী দলে যোগ দেন শিমুল। দায়িত্ব পান খুলনা অঞ্চলের। এরপর তিনি ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া। ২০১০ সালের আগপর্যন্ত খুলনা অঞ্চলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চরমপন্থীরা। ২০১০ সালে দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবু সাঈদ বাদল খুনের ঘটনাতেও শিমুল ভূঁইয়ার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।

শিমুল ভূঁইয়ার বড় ভাই হানিফ মুহাম্মদ ভূঁইয়ার বাড়িতেও আজ সকাল থেকে কেউ নেই বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী

ফুলতলা উপজেলা নিয়ে খুলনা জেলা পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ড থেকে ২০২২ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন সাবিনা ইয়াসমিন। ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিলেন শিমুল ভূঁইয়া। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের বলেছিলেন অন্য কাউকে প্রার্থী না করতে। এরপর ভয়ে আর কেউ প্রার্থী হননি।

ওই আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, শিমুল ভূঁইয়া ফুলতলা এলাকায় আসতেন না। তবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর নাম শুনলেই সবাই ভয়ে কাঁপেন। কেউ রোষানলে পড়লেই খুন করতেন। তবে গায়ে পড়ে অন্য কোনো ঝামেলায় জড়াতেন না।

ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলামও বলেন, শিমুল ভূঁইয়া ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে এলাকাছাড়া। এলাকাবাসীও হয়তো এখন তাঁকে দেখলে চিনতে পারবেন না। সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সরদার আলাউদ্দিন হত্যা মামলায় তাঁর স্ত্রী জামিনে ছিলেন।

খুলনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.