জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের আদেশও দেওয়া হয়েছে।
আদালতের এই আদেশের পর অনেকের মনে কৌতূহল তৈরি হয়েছে যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সম্পদ আসলে কত?
‘ডামি নির্বাচন’ নামে পরিচিত ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে শেখ হাসিনা (গোপালগঞ্জ-৩) ও আসাদুজ্জামান খান কামাল (ঢাকা-১২) হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁদের ঘোষিত সম্পদের তথ্য জানা যায়।
হলফনামায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজের নামে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছিলেন।
তখন নিজের হাতে নগদ অর্থ দেখিয়েছিলেন সাড়ে ২৮ হাজার টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় ২ কোটি ৩৯ লাখ। ছিল ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ৫৫ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর)।
শেখ হাসিনা হলফনামায় তিনটি মোটরগাড়ি দেখিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি উপহারের। সেটির দাম দেখাননি। বাকি দুটির দাম দেখিয়েছিলেন সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা। সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর দাম দেখিয়েছিলেন ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। নিজের আসবাবের দাম ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেখিয়েছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনা নিজের নামে থাকা কৃষিজমির পরিমাণ দেখিয়েছিলেন ১৫ দশমিক ৩ বিঘা, যার ক্রয়কৃত অংশের মূল্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা, যা টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ সদর, গাজীপুর ও রংপুরে।
গাজীপুর শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মৌচাকের তেলিরচালা এলাকায় বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পূর্ব পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘেঁষে রয়েছে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের একটি বাগানবাড়ি।
স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালের দিকে স্থানীয় এক ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ জমি লিখে দিয়েছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিক হয়েছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জমির কিছু অংশ সন্তানদের লিখে দেন। সেই সূত্রে মালিক হন শেখ হাসিনার সন্তান সজীব ওয়াজেদ ও সায়মা ওয়াজেদ এবং শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার সন্তান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক। নথিপত্রে জমির পরিমাণ ২৯৭ শতক (৯ বিঘা)।

হলফনামা অনুযায়ী, ঢাকার পূর্বাচলে একটি প্লট রয়েছে শেখ হাসিনার নামে, যার দাম ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর নামে এবং তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, ছোট বোন শেখ রেহানা (রেহানা সিদ্দিক), রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকের (রূপন্তী) নামে পূর্বাচলে ১০ কাঠা করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সব মিলিয়ে এই পরিবারের ছয়জন মোট ৬০ কাঠা জমি পেয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে এসব প্লট বরাদ্দের অভিযোগে দুদকের মামলা চলছে এখন।
হলফনামায় শেখ হাসিনা তিনতলা ভবনসহ ৬ দশমিক ১০ শতক (আংশিক) জমি নিজের নামে দেখিয়েছেন। এই জমি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। এর অর্জনকালীন মূল্য দেখানো হয়েছে ৫ লাখ টাকা।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ২২ মে এক ব্রিফিংয়ে জানায়, শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী হলফনামায় অসত্য তথ্য দিয়েছিলেন। ওই সময় হলফনামায় তিনি নিজ নামে থাকা জমির পরিমাণ ৬ দশমিক ৫০ একর বলে ঘোষণা দেন। কেনার সময় এ জমির অর্থমূল্য দেখানো হয় ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
দুদক বলেছে, তারা যাচাই করে দেখতে পায়, ওই সময় শেখ হাসিনার নামে ২৮ একর ৪১ শতকের বেশি স্থাবর সম্পদ ছিল। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দুদক নির্বাচন কমিশনকে তখন চিঠিও দেয়।
ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটির মালিকানা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের হাতে রয়েছে। শেখ হাসিনার বাসভবন ধানমন্ডির সুধা সদনের মালিকানা রয়েছে সজীব ওয়াজেদ ও সায়মা ওয়াজেদের নামে।

আসাদুজ্জামান খানের সম্পদ
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ঢাকা-১২ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি যে হলফনামা দিয়েছিলেন, তাতে ঘোষিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়।
আসাদুজ্জামান খান হাতে নগদ দেখিয়েছিলেন ৮৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা দেখান ৮২ লাখ টাকার মতো। বন্ড ও শেয়ার ছিল প্রায় ২৪ লাখ টাকার। ডাকঘর, সঞ্চয়পত্র অথবা স্থায়ী আমানত দেখিয়েছিলেন ২ কোটি ১ লাখ টাকা।
আসাদুজ্জামান খান দুটি মোটরগাড়ির দাম দেখিয়েছিলেন ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। তাঁর ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ও আসবাব ছিল ২ লাখ টাকার। তিনি ঋণ বাবদ ব্যবসার মূলধন দেখিয়েছিলেন ২ কোটি ২০ লাখ টাকার। সোনা দেখান ১০ ভরি, তবে দাম উল্লেখ ছিল না।
হলফনামা অনুযায়ী, আসাদুজ্জামান খানের কৃষিজমির পরিমাণ ১৭১ শতাংশ (৫ বিঘার বেশি), যার অর্জনকালীন মূল্য ১ কোটি ৬ লাখ টাকা। অকৃষিজমি সাড়ে ১৮ শতাংশ, যার অর্জনকালীন মূল্য সাড়ে ৫৮ লাখ টাকা। তিনি বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের ঘরে দুটি সম্পদের মূল্য দেখিয়েছেন। একটি গ্রামের বাড়ি বলে উল্লেখ করেছেন, যার অর্জনকালীন মূল্য ৮০ লাখ টাকা। অন্যদিকে আরেকটির মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে আসাদুজ্জামান খানের সম্পদের অর্থমূল্য ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকার মতো (১০ ভরি সোনার মূল্য বাদে)।
আসাদুজ্জামান খানের সম্পদের অনুসন্ধানও করছে দুদক। জ্ঞাত আয়ের বাইরেও তাঁর সম্পদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা। দুদক এ বিষয়ে মামলা করেছে। আদালতে বলা হয়েছে, তিনি অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ১৬ কোটি ৪২ লাখ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন ও দখলে রেখেছেন।
রায়ে যা বলা হয়েছে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। সেদিনই তিনি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। এখনো সেখানেই রয়েছেন। আসাদুজ্জামানেরও ভারতে অবস্থানের তথ্য পাওয়া যায়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদার রায়ে বলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো। এ মামলার জুলাই শহীদদের ‘কনসিডারেবল অ্যামাউন্ট অব কম্পেনসেশন’ (উল্লেখযোগ্য ক্ষতিপূরণ) দিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
আদালত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে রায়ের কপি দেওয়ার নির্দেশ দেন।
রাজীব আহমেদ
ঢাকা


















