‘বাইডেন বিরিয়ানির’ খলিলের বাইডেন পুরস্কার জয় এবং…

0
200
নিউইয়র্কে বাংলাদেশি খাবারকে পরিচিত করার জন্য কাজ করছেন মো. খলিলুর রহমান

যশোরের শার্শা উপজেলার শুড়া গ্রামের মো. খলিলুর রহমান। ২০০৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নিজের সঞ্চয় করা ১ হাজার ৭০০ ডলার পকেটে নিয়ে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। থাকার জন্য উঠেছিলেন দূরের আত্মীয় আজিজুর রহমানের বাড়িতে। মাত্র ১৫ বছর পর সেই খলিলুর এখন ছয়টি রেস্তোরাঁ, চারটি গাড়ি আর দুটি বাড়ির মালিক। পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পুরস্কার। তাঁর জীবনের গল্প রূপকথার মতো। সেই গল্প শুনতেই গিয়েছিলাম জ্যামাইকায় তাঁর খলিল বিরিয়ানির দোকানে। মনের অর্গল খুলে দিলেন খলিলুর রহমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর খলিল। উন্নত জীবনযাপনের আশায় গেলেন যুক্তরাষ্ট্র। আসার দুই সপ্তাহের মধ্যে নামমাত্র বেতনে কাজ নিলেন বাংলাদেশি এক গ্রোসারি শপে। বাংলাদেশের একটি বিমা কোম্পানির একসময়ের জোনাল ম্যানেজার খলিল গ্রোসারি শপে ছয় মাস কাজ করে আর টিকতে পারলেন না। এরপর কাজ করলেন দুটি বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয়। শেফের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে করতেই জন্মে রান্নার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ।

কাজের ফাঁকে প্রধান শেফ ও অন্যদের সঙ্গে যে আড্ডা হতো, সেখান থেকেই জানতে পারলেন, কোথায় পড়ালেখা করলে ভালো রন্ধনশিল্পী হওয়া যাবে। ২০১৪ সালে চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হলেন ইনস্টিটিউট অব কালিনারি এডুকেশনে।

কথায় আছে, ‘সাহসে লক্ষ্মী’। সেই লক্ষ্মীর ওপরে ভরসা আর নিজের আত্মবিশ্বাসের জোরে পড়ালেখা শেষ করার আগেই ২০১৭ সালে দ্য ব্রংসে নিজের নামে দিলেন রেস্টুরেন্ট। খলিল বিরিয়ানি। ১০ ফুট বাই ২৪ ফুট বড় রেস্টুরেন্টটি হয়ে গেল তাঁর প্রথম ঘর। দিনে ১২–১৬ ঘণ্টা কাজ শুরু করলেন। স্ত্রী সাহস জুগিয়েছেন পাশে থেকে। হান্টার কলেজে ডাক্তারি পড়া বড় মেয়ে প্রথম থেকেই বাবার ব্যবসায় যুক্ত থেকেছেন পড়ালেখার পাশাপাশি। পাশে পেয়েছেন ছেলেকেও।

রেস্টুরেন্টের নাম খলিল বিরিয়ানি হলেও দেশি মাছ, মাংস, সবজি, সমুচা, শিঙাড়া, কাবাবসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার পাওয়া যায় এখানে। তাই বাংলাদেশিদের রসনা তৃপ্তির অন্যতম প্রধান জায়গা হয়ে ওঠে এই রেস্তোরাঁ।

২০১৮ সালে পড়ালেখা শেষ করলেন সাফল্যের সঙ্গে। চাইলে বড় বেতনের চাকরি নিতে পারতেন। তা না করে নিজের ব্যবসায় আরও মনোযোগী হলেন। মনে ইচ্ছা, বাংলাদেশিদের খাবার আলাদা পরিচিতি পাবে বিশ্বব্যাপী। খাবার বিষয়ে পড়তে গিয়ে তিনি দেখেছেন, বাংলাদেশের প্রতিবেশী নেপালিদের আলাদা কুইজিন আছে। কিন্তু বাংলাদেশের নামে আলাদা কোনো খাবার নেই, সব পরিচিত ইন্ডিয়ান খাবার হিসেবে। নতুন আরেকটি প্রতিষ্ঠান করলেন একই এলাকায়, ‘খলিল হালাল চায়নিজ’ নামে। পরের বছর গড়ে তুললেন খলিল সুইটস অ্যান্ড বেকারি।

২০২০ সালে বাইডেন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, তখন ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক হিসেবে খলিল চালু করলেন ‘বাইডেন বিরিয়ানি’। নামের কারণে মানুষের মধ্যে তৈরি হলো অতিরিক্ত কৌতূহল। বিক্রিও দেদার। এ বিরিয়ানিতে মসলার বাহুল্য নেই। নানান দেশের মানুষ খেয়ে তৃপ্তি পান। রেস্টুরেন্টে আসেন কংগ্রেস সদস্যসহ মূলধারার অনেক রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ থেকে আসা কবি-সাহিত্যিক ও তারকারা।

২০২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এক হাজার বর্গফুটের খলিল সুপারমার্কেট। পরের বছর খলিল বিরিয়ানির আরেকটি শাখা করলেন জ্যামাইকায়। পরের বছর খলিল ফুড কোর্ট। সেখানে হরেক রকম খাবার পাওয়া যায়। খলিলুর বলছিলেন, অনেক রেসিপি আছে তাঁর নিজের। ছয়টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ৯০ জন কাজ করেন। শুধু নিজের ব্যবসা নয়, রন্ধনশিল্পে উৎসাহ দিতে বিনা মূল্যে মানুষকে শিখিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

স্বপ্ন দেখেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের খাবারের মতো বাংলাদেশি খাবারও জনপ্রিয় হয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী। সে লক্ষ্যে কাজও করছেন। বললেন, ৫০টি দেশে নিজের খাবার ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন।

কমিউনিটি সেবায় অবদানের জন্য ২০২২ সালে পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। পেয়েছেন আরও স্বীকৃতি।

অবসরে চোখ বন্ধ করলে তিনি দেখেন, জাল দিয়ে পুঁটি আর ট্যাংরা ধরছেন গ্রামের সেই বন্ধুদের সঙ্গে। স্মৃতিতে ভেসে আসে গোড়পাড়া বাজার। বাজারের আড্ডা, গ্রামের মানুষ। দেখতে পান বাবা ও মায়ের মুখটি।

তাই তো শার্শার গোড়পাড়া বাজারে প্রতিষ্ঠা করবেন খলিল ফুড লিমিটেড। নিউইয়র্কে তাঁর রেস্তোরাঁর মসলা তৈরি করা হবে সেখানে। খলিল বলছিলেন, শতাধিক মানুষ কাজ করবেন সেখানে। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়বে খলিল রেসিপি মসলা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.