অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশ। এ দেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন; আছে পাহাড়, পর্বত ও হাওর। এতকিছুর পরও ঋতুবৈচিত্র্যের এ দেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশ তলানিতে। দিন দিন কমছে বিদেশি পর্যটক। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাব, দুর্বল অবকাঠামো, প্রশাসন ও স্থানীয় অধিবাসীদের পর্যটনমনস্ক না হওয়া, পর্যটনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে ভ্রমণপিপাসুদের টানতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে কম খরচে ভ্রমণ ও বিনোদনের সুবিধা পেয়েও পর্যটকরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন। এমনকি বাংলাদেশের পর্যটকরাও দেশের গন্তব্য এড়িয়ে আশপাশের দেশে ছুটছেন।
এ পটভূমিতে আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘পর্যটনে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ’। দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের আয়োজনে চার দিনের ‘বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল’ আজ শুরু হচ্ছে।
কমছে বিদেশি পর্যটক
পর্যটন-সংশ্লিষ্টরা জানান, পর্যটন স্পটগুলোয় প্রতিবছর ভ্রমণ করেন প্রায় দেড় কোটি পর্যটক। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটক মাত্র ৩ থেকে ৫ শতাংশ। দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান শুধু ৪.৪ শতাংশ। অথচ পাশের দেশগুলো ১০ শতাংশের ওপরে অবদান রাখছে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে দেশে বিদেশি নাগরিক এসেছেন ৫ লাখ ৬৬৫ জন, ২০১৮ সালে ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ বিদেশি নাগরিক দেশে আসেন, এ সংখ্যা ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১। করোনার সময় ২০২০ সালে এসেছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন, ২০২১ সালে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন আর ২০২২ সালে দেড় লাখ বিদেশি আসেন। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার।
যেসব বিদেশি বাংলাদেশে আসেন, তাদের বেশির ভাগই ঘুরতে নয়; প্রশিক্ষণ, ব্যবসা কিংবা দাপ্তরিক কাজে এ দেশে এসেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজারের বিনোদন গালগল্পে বন্দি
পর্যটন এলাকা হিসেবে দেশে এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় কক্সবাজার। যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সুযোগ-সুবিধার কারণে বছরজুড়ে লাখো মানুষের সমাগম হয় সেখানে। তবে কক্সবাজারে দেখা যায় বেশির ভাগই দেশি পর্যটক। কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়া রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জুলফিকার আলম বলেন, ‘সুন্দর একটা সৈকত আছে, সেখানেই বসে আছি। এরপর রাতে রুমে বসে থাকতে হচ্ছে। শুধু উন্নত মানের থাকা-খাওয়া এবং বিনোদনের বন্দোবস্ত থাকাটাই যথেষ্ট নয়।’ ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আসা পর্যটক মোহাম্মদ ওমর বলেন, ‘কক্সবাজারে সৈকত, হোটেল ও প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকলেও রাত্রিকালীন যে বিনোদন প্রয়োজন, তা পাচ্ছি না। ভালো একটা শপিং মল, শিশু পার্ক, আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা হল, সৈকতেকেন্দ্রিক খেলাধুলাসহ কিছুই নেই।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পের বিকাশে কাজ করছে পর্যটন করপোরেশন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন। কিন্তু এই তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় নেই। ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান এককভাবে উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘কক্সবাজার পর্যটন এলাকার উন্নয়নে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কঠিন হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সৈকত হওয়ার পরও এটি অবহেলিত। সৈকতঘেঁষে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে অনেক হোটেল-মোটেল। প্রাকৃতিকভাবেই আমরা যে ইকো সিস্টেম পেয়েছি, সেটা আমাদের ব্র্যান্ডিং। মহাপরিকল্পনা শুধু সৈকতকেন্দ্রিক নয়, পুরো কক্সবাজারেই হোক।’
সরকারি সংস্থার উদ্যোগ কম
দেশের পর্যটন শিল্প এগিয়ে নিতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বাপক) ও বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড (বিটিবি) কাজ করে। মন্ত্রণালয়ের দুটি পর্যটন সংস্থায় লোকবল আছে, খরচও হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, মজুরি ভিত্তিতে কর্মরত জনবলসহ পর্যটন করপোরেশনে ৮৫০ ও পর্যটন বোর্ডে ২৯ জন কাজ করেন। ওই অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে বাপকের ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা ও বিটিবির প্রায় ৩৩ কোটি টাকা খরচ হয়।
বেশ কয়েক দিন আগারগাঁওয়ের বাপক কার্যালয়ে গিয়ে কিছু কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। আবার যারা আছেন, তাদের কাজ নেই, অনেকে অলস সময় কাটাচ্ছেন। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সাবেক প্রথম সহসভাপতি ও জার্নি প্লাসের পরিচালক তৌফিক রহমান বলেন, অর্থ খরচ করে করপোরেশন ও বোর্ডে দক্ষ লোকবল তৈরি করা হলেও তাদের ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে না। তাদের মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চলতে হয়। দেশের আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রের তালিকা করেছে বাপক। তালিকায় দেশের আট বিভাগে মোট ১ হাজার ৫২৯টি পর্যটনকেন্দ্রের নাম রয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি। ওই তালিকায় আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান হিসেবে আগারগাঁওয়ে বাপকের প্রধান কার্যালয়কেও রাখা হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন জাদুঘর তালিকায় স্থান পেলেও আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ বিমানবাহিনী জাদুঘরকে রাখা হয়নি। অথচ দেশের প্রথম বিমান জাদুঘর এটি।
হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্যাফেটেরিয়া, বারসহ পর্যটন করপোরেশনের মোট ৪৭টি ইউনিট বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪টি ইউনিট পরিচালনা করছে পর্যটন করপোরেশন। বাকি ১৩টি পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। বিভিন্ন সরকারের আমলে পর্যটন করপোরেশনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে দেওয়া হয়। এখনও ১০টি রেস্তোরাঁ ও বার, একটি সুইমিং পুল, একটি লেক ও একটি পার্ক নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি তারা।
পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও দেশের পর্যটন শিল্প কীভাবে এগিয়ে যাবে, তার কোনো মহাপরিকল্পনা এখনও হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছর পর জন্ম নেওয়া বাপক প্রায় চার দশকে মহাপরিকল্পনা করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যটন শিল্পকে তাদের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে রূপান্তর করলেও বাংলাদেশ সেই তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট, ফেসবুক ও ইউটিউবগুলোকে এখনও পর্যটকবান্ধব করা যায়নি।
টোয়াব সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী বলেন, দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে একজন পর্যটক দিনের বেলায় ঘুরে ঘুরে দেখলেন, রাতের বেলায় কী করবেন? এ দেশে পর্যটকদের জন্য নাইট লাইফ বলতে কিছু নেই। দেশের পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রচার দরকার। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিজ্ঞাপন দিতে হবে। পর্যটন এলাকার হোটেল, মোটেল, বার, স্পা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, সাগরে ক্যাসিনো, বিনোদন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সুবিধা বাড়াতে সরকারকে ট্যাক্স-ভ্যাট কমাতে হবে। দ্রুত অনলাইন ভিসা চালু এবং আগমনী ভিসার (অন অ্যারাইভাল) পরিধি বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) লাস ভেগাসের আদলে ‘অ্যারাবিয়ান স্ট্রিপ’ নামে একটি ক্যাসিনো খুব শিগগির চালু হতে যাচ্ছে। ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান ও থাইল্যান্ড বিদেশি পর্যটকদের যেভাবে আকৃষ্ট করে, বাংলাদেশে তা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পর্যটন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম নেটওয়ার্ক (ডব্লিউটিএন) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব সৈয়দ গোলাম কাদীর বলেন, সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে পর্যটন হবে না। নেপালের রেস্টুরেন্টগুলোতে ডিনারের সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেন পর্যটকরা। তবে আমাদের দেশে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে আমরা নানা কর্মসূচি নিয়েছি। মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে। বাংলাদেশকে আটটি অঞ্চলে এবং ৫৩টি ক্লাস্টারে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ১৯টি ক্লাস্টারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আনতেও বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ অনেক মুসলিম দেশ পর্যটকদের নানা সুবিধা দিচ্ছে। এ দেশে বিদেশি পর্যটকদের যে চাহিদা, তা পূরণ করার মতো মনমানসিকতা আমাদের নেই। সেই পরিবেশ বাংলাদেশে এখনও তৈরি হয়নি। তাই বিদেশি পর্যটক কম আসেন। আমাদের উদারনীতি নিতে হবে।