কাজ করার অনুমতি না নিয়ে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই বাংলাদেশে অবস্থান করতে পারছেন অনেক বিদেশি নাগরিক। আইনি দুর্বলতা ও বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের সমন্বিত কোনো তথ্যভান্ডার না থাকায় বিনা বাধায় তাঁরা এ দেশে বসবাসের সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁদের অনেকে বাংলাদেশে থেকে আয়রোজগার করলেও ঠিকমতো করও দেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি নাগরিকদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। কারণ, ধরা পড়লে জরিমানার অঙ্ক খুবই কম, মাত্র ৩০ হাজার টাকা। আবার অনেকে ভিসার শ্রেণি পরিবর্তন করেও বেশি দিন অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত ‘কর্মানুমতি ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক বৈঠকে এসব প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। এ কারণে অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে দৈনিক ভিত্তিতে জরিমানা আরোপের পাশাপাশি এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এ বৈঠকে। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশিদের যাঁরা চাকরি দেবেন, হোটেল বা বাসাভাড়া দেবেন, তাঁদেরও জরিমানার আওতায় আনার সিদ্ধান্তও হয়।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়াসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭ জন। চার ধরনের ভিসায় তাঁরা এ দেশে এসেছেন। এর মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ শ্রেণির ভিসায় ১০ হাজার ৪৮৫, কর্মসংস্থান ভিসায় ১৪ হাজার ৩৯৯, শিক্ষা ভিসায় ৬ হাজার ৮২৭ এবং পর্যটন ও অন্যান্য শ্রেণির ভিসায় ৭৫ হাজার ৪৫৬ জন বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক সবচেয়ে বেশি—৩৭ হাজার ৪৬৪ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চীনের নাগরিক—১১ হাজার ৪০৪ জন।
বৈঠক শেষে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, পূর্ণাঙ্গ তথ্য না থাকায় অনেকে অনুমান করে বলেন, ৪ থেকে ৫ লাখ বিদেশি আছেন দেশে। বিদেশিদের মধ্যে অনেকের অবৈধ অবস্থানের কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ আয়কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় কর্মীদের চাকরির সুযোগও সংকুচিত হচ্ছে।
আইনি দুর্বলতা বাংলাদেশেরই
বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থান করে কোনো কাজ করতে চাইলে সরকারের অনুমতি নিতে হয় এবং আয়কর দিতে হয়। কিন্তু বিদ্যমান ভিসা নীতিমালাই দুর্বলতা রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ২০০৬ সালের ভিসা নীতি কার্যকর রয়েছে। ২০১৯ সালে নতুন ভিসা নীতিমালা করা হলেও তা কার্যকর করেনি সরকার। আবার বাংলাদেশে অবস্থানকালে বিদেশিদের ভিসার শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগও রয়েছে।
বৈঠকে জানানো হয়, কর্মসংস্থান, ব্যবসা ও বিনিয়োগ ভিসা এবং পর্যটক ভিসায় এসে অনেকে কাজ করলেও ভিসা নীতিমালায় অনুমতি নেওয়ার শর্তই নেই। ফলে ভিসাধারীরাও তা নেন না। অনেকে বাংলাদেশে অবস্থান করেও ভিসার মেয়াদ বাড়াচ্ছেন। এমনকি কালোতালিকাভুক্ত বিদেশিদেরও নতুন পাসপোর্ট করার সুযোগ দিচ্ছে বিদেশি দূতাবাসগুলো। বৈঠকে এসব নিয়েও আলোচনা হয়।
যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে
অনুমতি ছাড়া কাজ করা বিদেশিদের ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিডা, বেপজা, বেজা, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, এনজিওবিষয়ক ব্যুরো, এনএসআই, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং পুলিশের এসবির প্রবেশযোগ্যতা থাকে, এমন একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার তৈরির সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এ কথা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, বাংলাদেশি মিশনগুলোর ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়া অনলাইন ও স্বয়ংক্রিয় করা হবে। বিদেশিরা যে শ্রেণির ভিসায় আসবেন, সেই শ্রেণি ছাড়া অন্য কোনো শ্রেণির ভিসা থাকলে, মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসা থাকলে এবং কাজ করার অনুমতি না থাকলে যেসব বাড়ি বা হোটেলে তাঁরা অবস্থান করবেন, সেসব হোটেল ও বাড়ির মালিকদেরও জরিমানা করা হবে। অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের জরিমানা দৈনিক ভিত্তিতে করা হবে অর্থাৎ যত দিন বেশি থাকবেন, তত দিনের জরিমানা আরোপের বিধান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান অবৈধ নাগরিকদের কাজে নেবেন, তাদেরও জরিমানা গুনতে হবে। সুরক্ষা সেবা বিভাগ যাঁদের কালোতালিকাভুক্ত করেছে, তাঁদের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মনে করেন, বিদেশিদের ক্ষেত্রে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাতে বছরে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে।