বাংলাদেশে এই প্রথম ডেঙ্গু টিকার সফল পরীক্ষা, চার ধরনেই কার্যকর

0
232
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু রোগের টিকার সফল পরীক্ষা হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকেরা এই টিকার সফল পরীক্ষা করেছেন। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন—ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গেছে, চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই এই টিকা কার্যকর। টিকার এই সফল পরীক্ষা নিয়ে একটি প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘ল্যানসেটে’ গতকাল বুধবার প্রকাশিত হয়েছে।

এই টিকার নাম দেওয়া হয়েছে টিভি-০০৫ (টেট্রাভেলেন্ট)।

এই টিকা গবেষকদের একজন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, এটি একটি আশাব্যঞ্জক ঘটনা। যেহেতু দেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রকোপ চলছে, তার মধ্যে এটি একটি আশার খবর।

কীভাবে হলো এই গবেষণা

ডেঙ্গু
ডেঙ্গুফাইল ছবি: বাসস

বাংলাদেশে ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫–এর দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ। শেষ হয় ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।

এতে অংশ নেন  ১৯২ জন। তাঁরা সবাই স্বেচ্ছায় অংশ নেন। প্রাপ্তবয়স্ক ১৮ থেকে ৫০ বছর (২০ জন পুরুষ ও ২৮ জন নারী), কিশোর ১১ থেকে ১৭ বছর (২৭ জন পুরুষ ও ২১ জন নারী), শিশু ৫ থেকে ১০ বছর (১৫ জন পুরুষ ও ৩৩ জন নারী) এবং ছোট শিশু ১ থেকে ৪ বছর (২৯ জন পুরুষ ও ১৯ জন নারী)। চারটি বয়সের শ্রেণিতে বাছাই করে টিকা বা প্লাসিবো করা হয়। অর্থাৎ প্রতি দলে ৪৮ জন করে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এসব ব্যক্তির কারও কারও আগেই ডেঙ্গু হয়েছিল, আবার কারও হয়নি। অংশগ্রহণকারীরা সবাই ছিলেন বাংলাদেশি। টিকার বেশির ভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল সামান্য।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম ছিল ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ। ১৪৪ জন টিকাগ্রহণকারীর ৩৭ জনের (২৬%) এবং ৪৮ জন প্লাসিবো প্রাপকের মধ্যে ৬ জনের (১২%) ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল ফুসকুড়ি। টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে জ্বর ছিল ৭ জনের (১৪৪-এর ৫%) ক্ষেত্রে এবং আরও ৭ জন গিঁটে ব্যথা (১০৮-এর ৬%) অনুভব করেছেন। টিকা গ্রহণের ১৮০ দিন পর সব অংশগ্রহণকারীর ( ১৪২ জন) মধ্যে বেশির ভাগ সেরোটাইপের (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন – ৪) বিপরীতে সেরোপজিটিভ দেখা গেছে।

গবেষক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘যারা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের আমরা ২০২০ সাল পর্যন্ত দেখেছি। তাঁদের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হননি।’

বাংলাদেশে এ বছর এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৯৬ হাজার ৮৩১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই বলছেন, এর বাইরে অন্তত চার গুণ বেশি মানুষ এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এ বছরের আগে দেশে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেই বছরও টিকা পাওয়া মানুষগুলো সুরক্ষা পেয়েছেন।

মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, এই টিকার একটি ডোজই সুরক্ষা দিতে পারে।  তবে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে এই টিকা নিয়ে। কারণ, বাংলাদেশে এর দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল বা পরীক্ষা হয়েছে। টিকাটি ৪২টি বিভিন্ন ধাপের ট্রায়াল সম্পন্ন  করেছে বিশ্বের নানা দেশে। ভারতের এর তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু হয়েছে। ডেঙ্গুর হাত থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে এর জোর সম্ভাবনা আছে।

বিজ্ঞানী  শফিউল আলম বলেন, ‘আমরাও চেষ্টা করছি এর তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল করার জন্য।’

দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস-এ প্রকাশিত এই গবেষণা  প্রতিবেদনে বলা হয়, দৈবচয়নভিত্তিক দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে টিভি-০০৫ টেট্রাভ্যালেন্ট লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড ডেঙ্গু টিকার নিরাপত্তা, ইমিউনোজেনিসিটি বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরির সক্ষমতা এবং তিন বছর পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধক্ষমতার স্থায়িত্বের অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়েছে। টিকা দেওয়ার পর বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে চারটি ডেঙ্গুর সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। যাঁরা পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেশি পাওয়া গিয়েছে। যদিও গবেষণাটি কার্যকর মূল্যায়ন করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি, তবে এখন পর্যন্ত টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো ঘটনা শনাক্ত করা যায়নি।

গবেষণাপত্রে বলা হয়, গবেষণালব্ধ এসব ফলাফল ডেঙ্গুপ্রবণ জনগোষ্ঠীতে ব্যাপক হারে টিভি-০০৫ ডেঙ্গু টিকা ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তোলার পাশাপাশি, তৃতীয় ধাপের কার্যকারিতা ট্রায়াল পরিচালনার জন্য সমর্থন জোগাড় করতে সহায়তা করবে।

দাম কত হবে এই টিকার

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন এই টিকার সফল পরীক্ষাকে স্বাগত জানান। তবে তিনি দুটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেগুলো হলো, এই টিকা যাদের এক বা একাধিকবার ডেঙ্গু হয়ে গেছে, তাদের দেওয়া যাবে কি না এবং এর দাম সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়ী হবে কি না।

গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬১ জন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন আগে, টিকার ট্রায়াল শুরুতে তাঁদের পরীক্ষা করে এটা বোঝা গেছে। তাই যাঁদের ডেঙ্গু হয়েছে, তারাও নিতে পারবেন। এই ৬১ জনের টিকা নেওয়ার পর আর ডেঙ্গু হয়নি; বরং তাঁদের অ্যান্টিবডির মাত্রা বেশি ছিল।

টিকাটি আবিষ্কার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ)।

দামের প্রসঙ্গে শফিউল আলম বলেন, ‘ভারতের তিনটি কোম্পানি ও ভিয়েতনামের একটি স্থানীয় ওষুধ কোম্পানি এই টিকা বাজারজাত করার অনুমতি পেয়েছে। যেহেতু স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বাজারজাত করার সুযোগ পেয়েছে, তাই এর দাম সাশ্রয়ী হবে বলেই ধারণা করি।’

মোহাম্মদ শফিউল আলম ছাড়াও এই টিকা গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রাশিদুল হক, সাজিয়া আফরিন ও মো.মাসুদ আলম।

ড. রাশিদুল হক বলেন, ‘একটি কার্যকর এবং টেট্রাভালেন্ট ডেঙ্গু টিকা বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব গুরুতর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণে টিভি-০০৫ টিকার গবেষণা করতে পেরে আমরা গর্বিত এবং আশা করি, আমাদের কাজ ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর টিকাপ্রাপ্তি ত্বরান্বিত করবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.