আপাতদৃষ্টে জনসংস্কৃতি বা ‘পপুলার কালচার’ ও গণসংস্কৃতি বা ‘মাসকালচার’ বিষয় দুটিকে একই মনে হলেও শব্দ দুটির মধ্যে অর্থ ও ব্যবহারিকতায় বেশ ফারাক রয়েছে।
একটি যদি হয় আমজনতার সংস্কৃতির প্রতিনিধি, তবে দ্বিতীয়টির মধ্যে ক্ষমতা ও বিনোদনের ভোক্তাশ্রেণি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। গণসংস্কৃতির অংশ হিসেবে গণমাধ্যম বিশাল এক প্রভাব রাখে জনসংস্কৃতির মনে। সামষ্টিকতার আন্দোলন বা মৃত্যুর হিসেবেও আমরা বলছি, গণ-আন্দোলন ও গণহত্যা। এখানে ‘জন (ব্যক্তি)’ অনুপস্থিত। ভোটের রাজনীতি ও পুঁজিবাদী বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ‘জন’ একপ্রকার চিহ্নিত একজন ভোক্তা হিসেবে। যে কারণে শব্দ ও ভাষার এই ধারণাগত পার্থক্য নির্ণয় আবশ্যক হয়ে ওঠে।
ক্ষমতাকাঠামোর বিচারে জনসংস্কৃতির মূল্য কতটুকু? পুঁজিবাদী সমাজে আদতে কি জনগণের হাতে কোনো ক্ষমতা থাকে? সমাজে সংস্কৃতির যে বিভিন্ন স্তর, সেখানে জনসংস্কৃতির জায়গাটাকে আমরা চিহ্নিত করছি বহুল ও বৃহত্তর এক গোষ্ঠীকে, যারা অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর এবং সাংস্কৃতিকভাবে অমূল্যায়িত; অথবা আধিপত্যবাদী ক্ষমতার হাতে পিষ্ট। বিখ্যাত ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়েরে বুর্দোর এক উক্তি উল্লেখ করা যাক এই প্রসঙ্গে, ‘যাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোনো মূলধন নেই, জনসংস্কৃতি তাদেরই।’ এখানে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূলধনকেও যোগ করতে পারি।
যেহেতু ক্ষমতা নেই, এই জনসংস্কৃতিকে আপনি চাইলে উচ্চবিত্তের ড্রয়িংরুমে বসেও বিভিন্নভাবে পরিচালিত ও প্রভাবিত করতে পারেন। এবং সেটি আরও বেশি হয়ে আসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কালে।
অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রেক্ষাপট ও নতুনত্বের সন্ধানে ১৯৬০-এর দশকের দিকে পশ্চিমে তো বটে বাংলাদেশেও বৃহত্তরভাবে ছড়িয়ে পড়ে জনসংস্কৃতির ধারণা, যা ভেঙে দিয়েছিল ‘সো-কলড’ উচ্চ ও নিম্নসংস্কৃতি চেতনার দেয়ালকে। কমিক বুক, রেডিও, টেলিভিশন উচ্চবিত্তের ড্রয়িংরুম ছেড়ে জনসংস্কৃতিরও প্রতিনিধিত্ব করা শুরু করে।
উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে যে শিল্পবিপ্লব ঘটে, তার প্রভাবে গোড়াপত্তন হয় আজকের নিঃসঙ্গতায় ভরা নগরসংস্কৃতির। মানুষ কৃষি ছেড়ে হয়ে উঠেছে শ্রমিকশ্রেণি। কৃষি ও কৌম সমাজের হৃদ্যতা ও অবসর বলে যেটুকু ছিল, তা যেন হারিয়েই গেছে।
শিল্পোন্নয়নের ফলে নাগর-সংস্কৃতির ঢেউ শুরুতে শহুরে জীবনে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে সেটি গ্রামগুলোতে বেশ ভালোভাবে ছড়িয়েছে। এর ভালো ও খারাপ—দুটি দিকই রয়েছে।
একসময় জনসংস্কৃতিতে যে বিষয়গুলো জনপ্রিয় ছিল, সেগুলো এখনকার প্রজন্মের কাছে পানসে লাগতে পারে। মূলধারার সংস্কৃতি বলে প্রচলিত যেকোনো কিছুকেই এখন বিশাল এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আপনার হাতে একটি স্মার্টফোন থাকা মানে এখন প্রান্তে বসেও অন্যের সঙ্গে মানসিক ও সাংস্কৃতিক সেতু গড়ার পাশাপাশি নতুন ভাবনার উদ্রেক করতে পারছেন আপনি। ‘কালচারাল হেজিমোনি’ বা সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের কাছে মাথা নোয়াতে হচ্ছে না।
জনসংস্কৃতি বলতে একসময়ের বটতলার পুঁথি থেকে শুরু করে লোকজ গান, পালা, যাত্রা, কীর্তনের যে প্রভাব ছিল, সেসবের এপিটাফ লেখাও ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
সংস্কৃতি অবশ্য ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এক জীবন্ত নদী। টিকটক দিয়ে হোক অথবা ইউটিউবে বিভিন্ন জনপ্রিয় কনটেন্ট বানাচ্ছেন যেসব কিশোর-তরুণ, তাদের আমরা এখন অস্বীকার করতে পারব না। একসময় জনসংস্কৃতি উচ্চ ও অভিজাতশ্রেণির কাছে ‘অ্যান্টিকালচার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এখন ফেসবুক-টুইটারের ছোট ছোট রিল ভিডিও তার প্রতিনিধিত্ব করছে না ঠিক, তবে জনসংস্কৃতিতে তার প্রভাব রাখার পাশাপাশি ভোক্তাশ্রেণি তৈরি করে ফেলেছে। অর্থনৈতিকভাবে যে সংস্কৃতির বাজারমূল্য রয়েছে, তার টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এর মানে এই নয় যে গত শতকে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি আর টিকে নেই বা তার মূল্য হারিয়েছে। বরং বলা ভালো, বিভিন্ন কারণে তার চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।
শতকের পর শতক পেরিয়ে গেলেও লেওনার্দো দা ভিঞ্চির শিল্পকর্ম ‘মোনালিসা’র দাম উল্টো বেড়েছে। ভিঞ্চি এই ‘মাস্টারপিস’ আঁকতে সময় নিয়েছিলেন চার বছর। কিন্তু এখনকার মেশিন যুগ হয়তো হুবহু চার দিনেই মোনালিসা এঁকে ফেলতে পারে। কিন্তু ধারণার যে অনন্যতা, মেশিন সেটি তো আর দিতে পারছে না।
আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক কন্টেন্ট দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তরুণ উচ্চবিত্তের কালচারকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারছে বটে, তবে তার শিল্পমূল্য কতটুকু? প্রয়াত সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা এক সাক্ষাৎকারে এক যথার্থ কথায় বলেছেন, ‘মূল্যবান জিনিস পপুলার না হলেও কোনো ক্ষতি নেই এবং লোক বোঝে বলেই এটা মূল্যবান।’
ফেসবুক-ইউটিউবের যুগে সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে আমজনতার। এর ভেতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে নিজেদের চাহিদামতো বা প্রতিনিধিত্বশীল সংস্কৃতি। একসময় টিভি পর্দায় যে কিশোর বা কিশোরীটি তার স্বপ্নের আইডলকে দেখত, এখন সে-ও মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যের ‘আইডল’ হয়ে উঠছে। এমন নয় যে এসব শুধু নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে হচ্ছে। তবে নাগরিক ও প্রান্তিক জনসংস্কৃতির ওপর তাদের যে প্রভাব, সেটি অবশ্য মাপতে হচ্ছে জনপ্রিয়তার দাঁড়িপাল্লায়।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাইরাল সংস্কৃতিকে ইমেজ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টাই যেন হয়ে উঠেছে একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্মের ধ্যানজ্ঞান। সামাজিক মূল্যবোধ বা রুচির দোহাই দিয়ে আসলে তাদের বিবেচনা করা অন্যায়। আদতে গণরুচি শেষ পর্যন্ত সাময়িকভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু তার স্থায়িত্ব ও স্থানিক প্রতিবেশ একসময় হ্রাস পায়। এবং নতুনভাবে আবারও ভিন্ন মাধ্যমে ভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
জনসংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারলে বা কথা বলতে না পারলে পরোক্ষভাবে তা আধিপত্যবাদের ছায়াতলে থেকে তারই প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে। তখন সবকিছুই বিনোদন হয়ে দাঁড়ায়, জনচেতনা গড়ে ওঠে না আর।