ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী প্রান্ত মিত্রকে (২৩) ছুরি মেরে হত্যার অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্য তিনজন ছিনতাইকারী দলের সদস্য। ওই দলের সদস্যরা জেলা জাকের পার্টির সভাপতি মশিউর রহমান ওরফে যাদু মিয়াকেও (৪২) কুপিয়ে জখম করেছেন।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান প্রেস ব্রিফিং করে এ দাবি করেন। আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এ প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ জুলাই রাত সোয়া দুইটার দিকে শহরের আলীপুর সেতুর কাছে প্রান্ত মিত্রকে চাকু মেরে হত্যা এবং ভোর পাঁচটার দিকে শহরের কমলাপুর ঠাকুরবাড়ি এলাকায় মশিউর রহমানকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করার ঘটনা ঘটে।
প্রান্ত মিত্র হত্যাকাণ্ড ও জাকের পার্টির নেতাকে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানানোর জন্য আয়োজিত ওই প্রেস ব্রিফিংয়ে লিখিত বক্তব্যে পুলিশ সুপার বলেন, ছিনতাইয়ের কাজে তিনজন জড়িত ছিলেন। তাঁরা ভাড়ায় একটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করে ছিনতাই করতেন। ওই তিন ছিনতাইকারী হচ্ছেন ফরিদপুর শহরের গুহলক্ষ্মী মহল্লার মো. সজীব শেখ (২৩), ফরিদপুর সদরের মমিনখার হাট এলাকার মো. ইস্রাফিল মল্লিক (৩৪) ও শহরের টেপাখোলা গোপালদি মাতুব্বরের ডাঙ্গী মহল্লার মো. সিফাতুল্লাহ ব্যাপারী (১৯)।
যে ব্যক্তির কাছ থেকে ওই তিন ছিনতাইকারী মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তির নাম মো. মাসুম শেখ (৩৪)। তিনি শহরের গুহলক্ষ্মীপুর এলাকার বাসিন্দা। পুলিশ তাঁকেও গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় ছিনতাই হওয়া প্রান্ত ও মশিউর রহমানের মুঠোফোন, ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত চাকু, একটি চাপাতি ও একটি রেঞ্জ, ছিনতাইকারীদের ব্যবহৃত রক্তমাখা জামা, একটি গামছা, এক জোড়া স্যান্ডেল জব্দ করা হয়।
পুলিশ সুপার জানান, গত ২৫ জুলাই ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রান্ত মিত্রের বন্ধু হৃদয় খানের বোনকে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ফরিদপুরের ডা. জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হৃদয়ের বোনের রক্তের প্রয়োজন হওয়ায় তিনি তাঁর বন্ধু প্রান্ত মিত্রকে বিষয়টি জানান। এ খবরে শহরের ওয়্যারলেসপাড়া এলাকার ভাড়া বাসা থেকে একটি রিকশায় প্রান্ত ওই হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন। হাসপাতালে যাওয়ার পথে রাত সোয়া দুইটার দিকে আলীপুর সেতুর উত্তর পাশে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রান্ত মিত্র নিহত হন। এই ছিনতাইকারীরাই ভোর পাঁচটার দিকে শহরের কমালাপুর ঠাকুরবাড়ির মোড় এলাকায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়া জেলা জাকের পার্টির সভাপতি মশিউর রহমানকে কুপিয়ে জখম করে মুঠোফোন ও টাকা নিয়ে যান।
প্রান্তের ঘড়ি ও হাতের আংটি ছিনতাইকারীরা কেন নেননি, জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ওই সময় আরেকটি মোটরসাইকেল ঘটনাস্থলের কাছাকাছি চলে আসায় ছিনতাইকারীরা দ্রুত পালিয়ে যান।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, গ্রেপ্তার ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা প্রান্তকে ছুরি মেরে হত্যা ও মশিউর রহমানকে কুপিয়ে জখম করার মধ্যবর্তী সময়ে আরও দুটি ছিনতাই করেন ফরিদপুর শহরে। ভোররাত পৌনে চারটার দিকে শহরের বাদামতলী সড়কে এক সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা এবং সোয়া চারটার দিকে শহরের ঝিলটুলী মহল্লা এলাকায় এক ইমামের কাছ থেকে মুঠোফোন ও ৭০০ টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যান।
ওই প্রেস ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সুমন রঞ্জন সরকার জানান, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকার শ্যামপুর এলাকা থেকে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য মো. সজীব শেখকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তাঁর কাছ থেকে প্রান্তের মুঠোফোনটি উদ্ধার করা হয়। পরে তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মধুখালী থানা এলাকা থেকে মো. ইস্রাফিলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর কাছ থেকে মশিউর রহমানের ছিনতাই হওয়া মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়। পরে তাঁদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে কানাইপুরে রাজীবের পরিত্যক্ত ঘর থেকে চাকু ও চাপাতি উদ্ধার করা হয়। রাত সাড়ে তিনটার দিকে মো. সিফাতুল্লাহকে টেপাখোলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আজ ভোর সাড়ে চারটার দিকে ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক মো. মাসুম শেখকে শহরের ভাজনডাঙ্গা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ জলিল বলেন, এ ব্যাপারে প্রান্তের বাবা বিকাশ মিত্র বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা এবং জাকের পার্টির নেতা মশিউর রহমানের ভাই মোকলেসুর রহমান বাদী হয়ে ছিনতাইয়ের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছেন।
প্রান্ত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শামীম হোসেন বলেন, আসামিদের আজ বিকেলে আদালতে সোপর্দ করা হবে। আদালতে তাঁরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দিলে তাঁদের রিমান্ডের আবেদন জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) শৈলেন চাকমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. আবদুল্লা বিন কালাম, ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক তুহীন লস্কর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এতে প্রান্ত মিত্রের বাবা বিকাশ মিত্র এবং মা পুতুল মিত্রও উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রান্তের মা পুতুল মিত্র কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি আসামিদের প্রশ্ন করেন, ‘আমার ছেলে তোদের কী ক্ষতি করেছিল যে তাকে এভাবে হত্যা করলি।’ তিনি হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে বলেন, ‘আর কোনো মাকে যেন আমার মতো ভাগ্য বরণ করতে না হয়।’