গত বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ-জাপান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপিত হয়েছে। আর এ বছরের ২৬ এপ্রিল আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-জাপান বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘সমন্বিত অংশীদারিত্ব’ থেকে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ উন্নীত হয়েছে। এই বিকাশের দুটি বড় প্রেক্ষাপট আছে। একটি ঐতিহাসিক, অন্যটি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিকে মেলানো পরিস্থিতি।
বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপিত হয়েছে। এ দুটি দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহযোগিতা বেশ পরীক্ষিত। এশিয়ার মধ্যে জাপানই বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য। জাপানই বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক সাহায্যদাতা। জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। দুটি দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কও বেশ আন্তরিক।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপানই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। জাপান তখনও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রভাব বলয়েরই একটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা চুক্তির বদৌলতে জাপান রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় সেই সময়ে। ১৯৭২ সালেই জাপানের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ দিনের বিরোধ প্রশমিত হয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়েই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপরীতে এবং পাকিস্তানের মিত্র। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাপানের সরকার ও জনগণের সমর্থন এবং বিজয়ের পরপরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত দুটি দেশের মধ্যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দ্বিতীয় টার্মিনাল, ঢাকার এমআরটি লাইনসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করছে জাপান।
দ্বিতীয় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট সাম্প্রতিক। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার বিপরীতে এশীয় দেশগুলো নিয়ে মুক্ত ভারত সাগরনীতি নিয়ে এগোচ্ছে জাপান। জাপানের প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক দিল্লি সফরের সময় এ ধারণা প্রকাশ করেন। ধারণাটি পশ্চিমা দেশগুলো গ্রহণ করেছে। কারণ, জাপানের বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই হয় এই মহাসাগর দিয়ে।
গত ২০ মার্চ জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ভারত সফর করেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে শিল্পায়নের কথা বলেন। এর পর ১১-১২ এপ্রিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ভারতের জাপানি রাষ্ট্রদূত মিলে ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন হয়। এরও মূল কথা ছিল বাংলাদেশ এবং জাপানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে কী করে ত্রিপুরার বাণিজ্যকে আরও উন্নত করা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপুরার যোগাযোগ এবং বঙ্গোপসাগরকে কাজে লাগানোর একটা পরিকল্পনার কথা জাপানিরা জানিয়েছে। ত্রিপুরার সাব্রুম থেকে জাপানি অর্থায়নে নির্মিত বাংলাদেশের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। এই পরিকল্পনা সফল হলে ভারতের ভূমি দিয়ে আবদ্ধ ত্রিপুরা রাজ্য এই প্রথম সামুদ্রিক বাণিজ্যের সুযোগ পাবে। চট্টগ্রাম বন্দরকে কাজে লাগিয়ে কী করে উত্তর-পূর্ব ভারতের পণ্য আরও বেশি করে রপ্তানি করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয় এই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে। সংগত কারণেই জাপান বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নতকরণ ও শিল্পায়নে বিনিয়োগের বড় অংশীদার।
এরই আলোকে দেখা যায় দুই দেশের যৌথ বিবৃতিকে। কূটনৈতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী কিশিদা যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এ সফরের ফলে বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সংলাপ, সফর বিনিময়, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কোর্স, সেমিনার, কর্মশালা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অন্য কোনো সম্মত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার হবে। জাপানের ভূমি, অবকাঠামো, পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সহযোগিতা স্মারক সই হয়েছে। এর ফলে মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, মেট্রোরেল নীতি, আইন ও প্রবিধান বিষয়ে সহযোগিতা, অবকাঠামো, নিরাপত্তা নীতি ও ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়বে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে মেট্রোরেলের সুফল আমরা ভোগ করতে শুরু করেছি।
তবে আগে জাপানের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক ছিল, সেটাকে শুধু সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বলা যেত। এখন দুই দেশের সম্পর্ক একটি কৌশলগত অংশীদারিত্বে পৌঁছেছে; বলা যায়। বাংলাদেশ-জাপানের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘ব্যাপক অংশীদারি’ থেকে সফলভাবে ‘কৌশলগত অংশীদারি’তে পৌঁছেছে। কৌশলগত অংশীদারির ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত তাৎপর্য রয়েছে। এতে দুই দেশের জনগণ ও সরকারের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার বোঝাপড়া, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা সামনের দিনগুলোতে আরও জোরদার হবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হলেও শুরুতে শুধু আমাদেরই সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এ সফরে আলোচিত রোহিঙ্গা ইস্যুর পাশাপাশি মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ (বিগ-বি) অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব নিয়ে আরও পরিকল্পনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের প্রতি জাপান সমর্থন দিয়েছে। জাপানের সমর্থন আগেও ছিল। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে কক্সবাজারে স্থানীয় জনগণের জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।
এ ছাড়া জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় চলতি বছরেই ঢাকা-নারিতা সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হতে যাচ্ছে। তাঁরা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে এমআইডিআই ও বিগ-বি উদ্যোগ গ্রহণ, বঙ্গোপসাগর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যোগাযোগ স্থাপন বিষয়েও আলোচনা করেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার হওয়ায় আমরা জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা জাপানের সঙ্গে আগামী দিনগুলোতে অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি সম্পন্ন করার অপেক্ষায় আছি।’ জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর দেশের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, বাংলাদেশ ও জাপান তাদের সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় এক মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছে এবং আমরা বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থনদান অব্যাহত রাখব।
বৈঠকে উভয়েই কৌশলগত অংশীদার হিসেবে আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে অবাধ ও উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বজায় রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, যখন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে রয়েছে। গত মাসে ঘোষিত অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক পয়েন্টের নতুন পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুই দেশ ব্যাপক ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সম্মত হয়েছে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নশীল দেশ এবং একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য। তাই টোকিওর প্রত্যাশা, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত