চুরি, ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধে হাতেখড়ি। এরপর জড়িয়ে পড়েন মাদক কারবারে। আধিপত্য বজায় রাখতে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। নামের সঙ্গে যুক্ত হয় কিশোর গ্যাং নেতা। পুলিশের খাতায় তোলেন নাম। ছিনতাই, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, মাদকের ২০টি মামলাও হয় তাঁর বিরুদ্ধে। চাঁদা আদায় ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে কথায় কথায় প্রকাশ্যে ছোড়েন গুলি। রয়েছে ‘টর্চার সেল’ও। চট্টগ্রামের আলোচিত এই ‘সন্ত্রাসীর’ নাম শহীদুল ইসলাম। এলাকার মানুষ ও পুলিশের কাছে তিনি পরিচিত বুইস্যা নামে।
চট্টগ্রাম নগরের আলোচিত ‘সন্ত্রাসী’ শহীদুল ওরফে বুইস্যা চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ এলাকার মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম। পুলিশ বলছে, মাদক বিক্রি ও চাঁদাবাজির টাকা দ্রুত গুনতে তাঁর রয়েছে টাকা গণনার যন্ত্র। তাঁকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর কথা বলছে পুলিশ। ইতিমধ্যে তাঁর কিছু সহযোগী গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
শহীদুল ইসলাম বুইস্যা ও তাঁর বাহিনীর লোকজন চাঁদা না পেলেই গুলি ছোড়েন। এই কারণে চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকেন। সর্বশেষ ৪ অক্টোবর বুইস্যার সহযোগী মুন্না পাঁচলাইশ বাদুরতলা এলাকায় একটি গ্যারেজের সামনে গুলি ছোড়েন। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, বিজয় চৌধুরীর গ্যারেজের সামনে এসে হুমকি দিতে থাকেন মুন্না। একপর্যায়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি করেন। তবে এ ঘটনায় কেউ আহত হননি। পরবর্তী সময়ে গ্যারেজ মালিকসহ আশপাশের লোকজন ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করলে মুন্না পালিয়ে যান।
কে এই বুইস্যা
ভোলার দৌলতখান থানা সদরের মোহাম্মদ আলীর ছেলে শহীদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যা। চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম ষোলোশহর এলাকায় থাকেন তিনি। পড়াশোনা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। কোনো রকমে নিজের নামটি লিখতে পারেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাবেশে দলবল নিয়ে যোগদান করতেন তিনি। সেসবের ছবি, ভিডিও রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নিজেকে পরিচয় দিতেন নিষিদ্ধ সংগঠন নগর ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে। তবে কোনো পদে ছিলেন না।
পুলিশ জানায়, শুরুতে চুরি, ছিনতাই করতেন। গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে জটলা পাকিয়ে লোকজনের জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতেন। পরে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি করে আসছেন।
গত বছরের মার্চে নগর পুলিশের করা এক জরিপে উঠে আসে, চট্টগ্রাম নগরে সক্রিয় প্রায় ২০০ কিশোর গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ৪০০ জনের মতো। গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত। তাঁদের প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় ৬৪ ‘বড় ভাই’ থাকার কথা সেই জরিপে উঠে আসে। তালিকায় শহীদুল ওরফে বুইস্যার নামও রয়েছে।

চাঁদা না পেলেই গুলি
শহীদুল ইসলাম বুইস্যা ও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা চাঁদা না পেলেই গুলি ছোড়েন। এই কারণে চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকেন। সর্বশেষ ৪ অক্টোবর বুইস্যার সহযোগী মুন্না পাঁচলাইশ বাদুরতলা এলাকায় একটি গ্যারেজের সামনে গুলি ছোড়েন। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, বিজয় চৌধুরীর গ্যারেজের সামনে এসে হুমকি দিতে থাকেন মুন্না। একপর্যায়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি করেন। তবে এ ঘটনায় কেউ আহত হননি। পরবর্তী সময়ে গ্যারেজ মালিকসহ আশপাশের লোকজন ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করলে মুন্না পালিয়ে যান।
গত বছরের ১০ নভেম্বর চান্দগাঁও থানার পাশে একটি মোটরগ্যারেজে চাঁদা না পেয়ে গুলি করেন স্বয়ং শহীদুল। গ্যারেজের মালিক মারুফ খান জানান, তাঁদের কাছে ফোন করে প্রথমে ২০ লাখ টাকা, পরে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা না দেওয়ায় গুলি করা হয়। একই বছরের ১৯ অক্টোবর শহীদুল ও তাঁর সহযোগীরা মনিরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করেন।

৩০ সদস্যের বাহিনী, আছে বিদেশি অস্ত্র
চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ এলাকায় ৩০ জনের বাহিনী গড়ে তুলেছেন শহীদুল। এলাকায় মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে তাঁরা জড়িত বলে পুলিশ জানায়। শহীদুলের সহযোগীদের মধ্যে আইয়ুব আলী, ইদ্রিস, ইয়াসিন, শিবু, রাকিব, সবুজসহ অনেকে রয়েছেন।
‘সন্ত্রাসী’ শহীদুল ইসলামের কাছে কত অস্ত্র আছে নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি পুলিশ। ৯ অক্টোবর শহীদুলের তিন সহযোগীর কাছে থেকে ১৩টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ১৩টি ম্যাগাজিন, ৫৮টি বুলেট উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ২০ জুলাই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শহীদুল ও তাঁর বাহিনীর প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর বেশ কয়েকজন সহযোগীর হাতে অস্ত্র থাকার ছবি ও ভিডিও আলোচিত হয়। শহীদুলের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় থাকা ২০ মামলার মধ্যে আটটি অস্ত্র মামলা। অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে এসে আবার জড়িয়ে পড়েন অপরাধে। ২০২৩ সালের ২৩ মে কালুরঘাট এলাকা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। তিন মাসের মাথায় জামিনে বেরিয়ে আসেন। এরপর পুলিশ আর তাঁর নাগাল পাচ্ছে না।
বহদ্দারহাটে ‘টর্চার সেল’
নগরের চান্দগাঁও বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এলাকার একটি ভবনের তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটকে ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করতেন শহীদুল ইসলাম। গত ২১ জুলাই সেখানে অভিযান চালিয়ে তাঁর ১১ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে বেশ কিছু দেশি অস্ত্র, গুলি ও গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে থানা থেকে লুট হওয়া গুলি ও গুলির খোসা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। চান্দগাঁও থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জামিনে থাকা ‘সন্ত্রাসী’ ইসমাইল হোসেন ওরফে টেম্পো ও শহীদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যার বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়। এ সময় কেউ হতাহত হননি। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এলাকায় সন্ত্রাসী শহীদুল ইসলামের একটি আস্তানার সন্ধান পায়। সেখানে থানা থেকে লুট হওয়া দুটি গুলি ও গুলির খোসা পাওয়া গেছে। ওসি আরও বলেন, আস্তানাটিকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যাঁরা এসব সন্ত্রাসীর চাহিদামতো চাঁদা কিংবা টাকা দিতেন না, তাঁদের সেখানে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। আস্তানায় প্লায়ার্স, রামদা, সিসিটিভি ক্যামেরাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট নগরের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে হামলা ও অস্ত্র–গুলি লুটের ঘটনা ঘটেছিল।

মেশিনে চাঁদাবাজির টাকা গণনা
পুলিশ ১০ অক্টোবর নগরের শুলকবহর এলাকায় অভিযান চালিয়ে শহীদুলের তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে একটি বাড়ির ভেতর থেকে মাদক, অস্ত্রের পাশাপাশি টাকা গণনার যন্ত্রও উদ্ধার করে।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহেদুল কবির বলেন, কিশোর গ্যাং নেতা ‘সন্ত্রাসী’ শহীদুল ও তাঁর সহযোগীরা চান্দগাঁও এবং পাঁচলাইশ এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও গুলি ছোড়ার মতো ঘটনা ঘটাতেন। শহীদুল শুলকবহর এলাকার একটি স মিলের পাশে ভবনের কক্ষকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করতেন। সেখানে রাখা ছিল টাকা গণনার যন্ত্র। ব্যাংকে ব্যবহৃত এই যন্ত্র দিয়ে চাঁদা ও মাদক বিক্রির টাকা গোনা হতো। তাঁকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। ইতিমধ্যে তার অনেক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অস্ত্র, চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘সন্ত্রাসী’ শহীদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যার বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে। তবে ফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বহদ্দারহাট এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছেন শহীদুল। এ জন্য আতঙ্কে থাকেন তাঁরা। কখন কী হয়ে যায়।