পি কে হালদারের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা ফেরতের ব্যবস্থা কী

0
168
আমানত ফেরত পাওয়ার জন্য আন্দোলনকারীরা

মানুষ বিশ্বাস করে নিজের জমানো টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখেন। এসব টাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আছে নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার (এসএলআর) বিধান। পাশাপাশি চালু আছে আমানত বিমা তহবিল। জনগণের জমানো টাকার নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়মকানুন জারি করা ও সার্বক্ষণিক তদারকি অব্যাহত রাখা। তবে এর ব্যতিক্রম যে হয়েছে, তার উদাহরণ পি কে হালদার।

নিয়ন্ত্রকদের তদারকি দুর্বলতার কারণে আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার বনে গিয়েছিলেন চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। প্রতিষ্ঠান চারটি হলো পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) ও এফএএস ফাইন্যান্স। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের জন্য আলোচিত হন পি কে হালদার।

পি কে হাওলাদারের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের চিত্র

এখন চার প্রতিষ্ঠানই ধুঁকছে, আর আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। এর মধ্যে প্রথম তিনটি প্রতিষ্ঠান এখন পরিচালিত হচ্ছে আদালত গঠিত পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে, পরেরটি পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) গঠিত পর্ষদের মাধ্যমে।

যখন পি কে হালদার এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নেন, তখন তিনি ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আভিভা ফাইন্যান্স (সাবেক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স) ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই দুই প্রতিষ্ঠানও এখন ধুঁকছে, সে জন্য নামও পরিবর্তন করতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটি চট্টগ্রামের একটি গ্রুপের মালিকানাধীন। আর এখন পি কে হালদার আটক আছেন ভারতের জেলে।

কার ঋণ, কত খেলাপি
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত মার্চ মাসের তথ্য অনুযায়ী, আভিভা ফাইন্যান্সের বিতরণ করা ঋণ ছিল ২ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৯৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৩০ শতাংশ। এই প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে ব্যাংক ও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তা ফেরত পাচ্ছে না। তবে ছোট আমানতকারীদের টাকা ধীরে ধীরে ফেরত দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

পিপলস লিজিংয়ের ঋণের পরিমাণ ৯১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ৯০৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৯ শতাংশ। এই প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাতে পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দিয়েছে আদালত। তবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। প্রতিষ্ঠানটি ঋণের টাকাও তুলতে পারছে না, আর কোনো টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। একই অবস্থা বিআইএফসিরও। এটির ঋণের পরিমাণ ৭৭৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ৭৫৪ কোটি টাকা। মোট ঋণের ৯৭ শতাংশই খেলাপি।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংও পরিচালনা করছে আদালত কর্তৃক নিযুক্ত পরিচালনা পর্ষদ। এর ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ১২৯ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা বা ৯০ শতাংশ।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, ‘যাঁরা টাকা নিয়েছেন তাঁরা ফেরত দিতে চান না। কথা দেওয়ার পরও বেশির ভাগ কথা রাখছেন না। এর মধ্যে অনেকেই প্রভাবশালী। চলতি বছরে প্রায় ২৩-২৪ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এর মধ্যে ২০ কোটি টাকা আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। টাকা উদ্ধারের জন্য মামলা হয়েছে এবং আরও মামলার প্রস্তুতি চলছে।’

এদিকে এফএএস ফাইন্যান্স পরিচালনা করছে বিএসইসি কর্তৃক মনোনীত পরিচালনা পর্ষদ। প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ১ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। এই পরিমাণ মোট ঋণের ৯০ শতাংশ। এই প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীরাও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।

কে এই পি কে হালদার
পি কে হালদারের জন্ম পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রামে। বাবা প্রয়াত প্রণনেন্দু হালদার ও মা লীলাবতী হালদার। তাঁর মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

পি কে হালদার ও তাঁর ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার দুজনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে দুজনই ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ (আইবিএ) থেকে এমবিএ করেন। পাশাপাশি চার্টার্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট (সিএফএ) কোর্স সম্পন্ন করেন পি কে হালদার।

শিক্ষাজীবন শেষে পি কে হালদার যোগ দেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি সেটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ছিলেন। ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৯ সালে তিনি আভিভা ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। যেভাবে তিনি শীর্ষ পর্যায়ে ওঠেন, তাঁকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বর্ণনা করেন ‘অদৃশ্য আশীর্বাদ’ হিসেবে। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন পি কে হালদার। এ সময়ের মধ্যে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা নিয়ে টাকা বের করে নেন। আর দেশে–বিদেশে সম্পদ গড়ে তোলেন।

পি কে হালদার ও প্রীতিশ কুমার হালদার দুই ভাই মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে কোম্পানি খোলেন ২০১৮ সালে। যার অন্যতম পরিচালক হন প্রীতিশ কুমার হালদার। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাঁদের কার্যালয়। আর কানাডায় পি অ্যান্ড এল হাল হোল্ডিং ইন্‌ক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে, যার পরিচালক পি কে হালদার, প্রীতিশ কুমার হালদার ও তাঁর স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। কানাডা সরকারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার টরন্টো শহরের ডিনক্রেস্ট সড়কের ১৬ নম্বর বাড়িটি তাঁদের।

২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে যখন তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের টাকা ফেরত দিয়ে ব্যর্থ হতে শুরু করে, তখন পি কে হালদার ভারতে পালিয়ে যান। পরে তিনি বসবাস করেন কানাডা ও সিঙ্গাপুরে। এরপর আবার চলে আসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে পি কে হালদারসহ পাঁচজনকে গত বছরের মে মাসে গ্রেপ্তার করে দেশটির আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত তদন্তকারী সংস্থা ইডি। পি কে হালদার এখন ভারতের কারাগারে। তাঁকে হস্তান্তরের জন্য দিল্লিকে অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন,‘আমানতকারীরা তাঁদের টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সময়মতো তদারকি করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেখানে–সেখানে টাকা চেয়ে কোনো লাভ হবে না, টাকা ফেরত পেতে তাঁদের সর্বোচ্চ জায়গায় যেতে হবে। আর পি কে হালদার ধরা খেলেও প্রকৃত দোষীরা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পাচ্ছেন। তাঁদের কিছু হচ্ছে না।’

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘আর্থিক খাতে আরও পি কে হালদার বহাল তবিয়তে আছেন। আরও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাঁরা ফাঁকা করে ফেলছেন। মূল দায় চট্রগ্রামের গ্রুপটির। তাদের ওপর থেকে সরকারের ছায়া না উঠলে আর্থিক খাত ঠিক হবে না।’

যত প্রতিষ্ঠান
মূলত শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন পি কে হালদার। এভাবে নিয়ন্ত্রণ নেওয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পিপলস লিজিং ও বিএফআইসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একধরনের সহায়তা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের আগের পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য আইন ভেঙে নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই সুযোগে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠান দুটির নিয়ন্ত্রণ নেন পি কে হালদার।

বিআইএফসির নিয়ন্ত্রণ সুকুজা ভেঞ্চার ও কাঞ্চি ভেঞ্চার নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। আরজেএসসি সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের একই দিনে এ দুটি প্রতিষ্ঠান কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। সুকুজা ভেঞ্চারের শেয়ার সুখাদা লিমিটেড ও সুকুমার মৃধার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধার হাতে। এর মধ্যে অনিন্দিতা মৃধার শেয়ারই ৯০ শতাংশ। আর সুখাদা লিমিটেডের মনোনীত পরিচালক ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফানউদ্দিন আহমেদ। ইরফানউদ্দিন আহমেদ কিছুদিনের জন্য বিআইএফসির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। আর কাঞ্চি ভেঞ্চারের ৯৫ শতাংশ শেয়ার হাল ইন্টারন্যাশনালের হাতে, যার প্রতিনিধিও ইরফানউদ্দিন আহমেদ।
পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল আনন কেমিক্যাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। আবার আনন কেমিক্যালের ৯৪ শতাংশ শেয়ার প্রীতিশ কুমার হালদারের হাতে ও ৫ শতাংশ শেয়ার তাঁর খালাতো ভাই অভিজিৎ অধিকারীর হাতে।

অন্যদিকে এফএএস ফাইন্যান্সের নিয়ন্ত্রণ পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল ও রেপটাইলস ফার্মের হাতে। আবার রেপটাইলস ফার্মের মালিকানায় আছে পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল, কেএইচবি সিকিউরিটিজের এমডি রাজীব সোম ও তাঁর স্ত্রী শিমু রায়। এর ফলে ময়মনসিংহের কুমির চাষ প্রকল্পটি বনে গেছে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। মালিক মূলত পি কে হালদারই।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ হাল ইন্টারন্যাশনাল, বিআর ইন্টারন্যাশনাল, নেচার এন্টারপ্রাইজ, নিউ টেক এন্টারপ্রাইজের হাতে। এসব প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। হাল ইন্টারন্যাশনালের ৭০ শতাংশ শেয়ারের মালিক পি কে হালদার নিজে।

জানা যায়, সব শেয়ার অন্যদের নামে হলেও ঘুরেফিরে আসল মালিক পি কে হালদারই। নিজেকে আড়ালে রাখতে এমন কৌশল নেন তিনি। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পি কে হালদার গড়ে তুলেছেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে।

এর মধ্যে রয়েছে পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল, পি অ্যান্ড এল অ্যাগ্রো, পি অ্যান্ড এল ভেঞ্চার, পি অ্যান্ড এল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রাভেল, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি অন্যতম। এর বাইরে রয়েছে আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, সুখাদা লিমিটেড, রেপটাইল ফার্মসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান।

কাগজে-কলমে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার ও তাঁর স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারীসহ বিভিন্ন আত্মীয়। আবার ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফানউদ্দিন আহমেদ ও সাবেক সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দীও আছেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়।

সানাউল্লাহ সাকিব

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.