আপনি তাঁর নামের পাশে কী বিশেষণ বসাবেন? অনন্য? অসাধারণ?
হয়তো কোনো শব্দই যথেষ্ট নয়। কারণ, তাঁর খেলা শব্দের সীমা ছুঁয়ে গেছে। কোনো ভাষায় বোঝানো অসম্ভব ঋতুপর্ণা চাকমার বাঁ পায়ের জাদু। মিয়ানমারের বিপক্ষে তাঁর গোল দুটি সবাইকে চমকে দিয়েছে। গোল তো নয় যেন বিস্ময়। ২১ বছরের এক তরুণীর ভেতর লুকিয়ে থাকা অসীম সম্ভাবনার আগুনও তাতে বেরিয়ে এসেছে নতুনভাবে।
বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমার র্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে। কিন্তু সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে আজ যখন বাংলাদেশের নারী ফুটবল এক নতুন সূর্যোদয়ের মুখোমুখি, সেই পথে সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার নাম ঋতুপর্ণা। মিয়ানমারের বিপক্ষে বাংলাদেশের ২-১ গোলে জয়ে ২টি গোলই তাঁর। দুটিই বাঁ পায়ের।
প্রথম গোলটায় ঋতুপর্ণার দারুণ দক্ষতার পরিচয় মেলে। তাঁর নেওয়া ফ্রি–কিক মিয়ানমারের মেয়েদের তোলা দেয়ালে লাগার পর নিজেই বলটা পেয়ে নিখুঁত প্লেসিংয়ে জড়িয়ে দিলেন জালে। মিয়ানমারের গোলকিপার বাঁ দিকে ডাইভ দিলেও বলের নাগাল পাননি।
দ্বিতীয়টি তো অনন্য। বাঁ দিক থেকে বক্সের পাশ ঘেঁষে দুর্দান্ত এক শটে গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে বল জড়িয়ে দেন জালে। ইয়াঙ্গুনের থুউন্না স্টেডিয়ামের গ্যালারি স্তব্ধ। ছোটখাটো গড়নের এক তরুণী যেন বিদ্যুতের মতো চিরে দিলেন প্রতিপক্ষকে। সে এক জাদুকরি মুহূর্ত!
২০২২ ও ২০২৪—বাংলাদেশের দুটি সাফজয়ী দলেরই গর্বিত সদস্য ঋতুপর্ণা। প্রথমবার আলো ছিল সাবিনা খাতুনের ওপর। ঠিক দুই বছর পর কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ যখন সাফ শিরোপা ধরে রাখে, তখন সেই আলোর কেন্দ্রে ঋতু। সাফের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি যেন তাঁর বাঁ পায়ের শিল্পকেই স্বীকৃতি দিয়েছে নেপালের রাজধানীতে।
নেপালের বিপক্ষে ফাইনালে ৮১ মিনিটে তাঁর বাঁ পায়ের জয়সূচক গোলটি দেখতে অনেকটা ক্রসের মতো, কিন্তু সেটি ঢুকে যায় সরাসরি জালে। যা এখনো অনেকের চোখে ভাসে।
কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে গত সাফের ফাইনালে তাঁর জয়সূচক গোল ২০ হাজার দর্শককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। গোল উদ্যাপনেও ছিল সেই জবাব। দর্শকদের চুপ করানোর ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ঋতুপর্ণা এসেছেন আপন আলোয় আলো ছড়াতে। অনেকটা একই রকম গোল করে আজও তিনি নিস্তব্ধতায় ডুবিয়ে দেন গ্যালারিকে।
বাঁ প্রান্তে খেলা ঋতুর গতি দুর্দান্ত, বল নিয়ন্ত্রণে দক্ষতা অবাক করে দেয়। কিন্তু সবচেয়ে ভালো তাঁর শুটিং। বাঁ পায়ের এমন নিখুঁত শট বাংলাদেশের নারী ফুটবলে আর কারও পায়ে দেখা যায় কমই। তাঁর গোলগুলো দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটাই বাক্য, ‘ঋতু, ইউ বিউটি।’ কেউ কেউ তো বলেই ফেলেন, ‘এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সেরা অ্যাথলেট ঋতুপর্ণা চাকমা।’
তাই তো কোচ পিটার বাটলার বাদ দেননি তাঁকে। যদিও গত ৩০ জানুয়ারি ১৮ জন নারী ফুটবলার বাটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, ঋতু ছিলেন তাতে। কিন্তু দল পুনর্গঠনের সময় ঋতু, মনিকা, মারিয়া, তহুরাদের সুযোগ দেওয়া দিয়েছেন ব্রিটিশ কোচ।
বাটলার জানতেন, কার হাতে আছে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। জানতেন, কাকে তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বড় মঞ্চে আবারও সেটি মনে করিয়ে দিলেন ঋতুপর্ণা।
ভুটানে লিগ খেলছিলেন ঋতু। সেখান থেকে ছুটি নিয়ে ফিরে এসে প্রথমে জর্ডান সফরে যান দলের সঙ্গে। এবার মিয়ানমার সফরে দলকে ইতিহাসের দোরগোড়ায় নিয়ে গেলেন পাহাড়ি কন্যা। বাংলাদেশ এবারই প্রথম নারী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে যাচ্ছে, বলাই যায়। এক যুগান্তকারী সাফল্যের হাতছানি সামনে, আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্ম হয়েছে ঋতুপর্ণার বাঁ পায়ের জাদুতে দুটি অনবদ্য গোলের কল্যাণে।

কিন্তু এ সাফল্যের পেছনে আছে ঋতুর ব্যক্তিগত তীব্র শোক আর লড়াইয়ের এক নিভৃত ইতিহাসও। তিন দিন আগেই ২৯ জুন বাহরাইনের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে ঋতু ফেসবুকে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে নিজের একটি ছবি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘আজ তোমার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী সিজি, তোমায় অনেক ভালোবাসি। সবাই আমার ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করবেন।’
ঋতুর ছোট ভাই পার্বণ চাকমা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন ২০২২ সালে। সেদিন বাংলাদেশের ৭-০ গোলের জয়ে ঋতু করেছিলেন ১টি গোল। সেই গোলের পর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাইকে যেন স্মরণ করেন ঋতু। ভাইকে অকালে হারানো শোক তাঁকে আরও শক্তি দিয়েছে। দিয়েছে এগিয়ে চলার সাহস।
দারিদ্র্য ঋতুকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বাবা বরজ বাঁশি চাকমা কৃষক ছিলেন, পরে ক্যানসারে মারা যান। পরিবারে তখন নেমে আসে দুঃসহ সংকট।
কিন্তু মেয়েটি থামেনি। রাঙামাটির ছোট গ্রাম মগাছড়ির মাঠে ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে পায়ের নখ উঠে গিয়েছিল ঋতুর। বীরসেন চাকমা নামের এক স্কুলশিক্ষকের সহায়তায় এগিয়ে যেতে থাকেন। তৃতীয় শ্রেণির সেই মেয়ে একদিন হয়ে উঠবেন দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলের রত্ন, কে জানত!

এই ঋতুপর্ণা আজ শুধু একজন ফুটবলার নন, বাংলাদেশের মেয়েদের লড়াই-সংগ্রামের এক প্রতীকও। তিনি গোল করেন; কারণ, জীবন তাঁকে শিখিয়েছে, হার মানা চলবে না। ১০ বছর আগে পিতৃহারা মেয়েটি নানা বাধা পেরিয়ে চলতে চলতে শিখেছেন, বাঁ পায়ের একটি নিখুঁত শট দিয়েই ইতিহাস লেখা যায়। ঋতুপর্ণা তা লিখে চলেছেন।
মাসুদ আলম
ঢাকা