পাল্টেছে ভোক্তা ঠকানোর ধরন, পাল্টেনি আইন

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস আজ

0
161
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর

পাল্টেছে ভোক্তা ঠকানোর ধরন। ঠকবাজদের নানা কৌশলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তা। তবে আইনের কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে অপরাধীকে যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে পারছে না জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ফলে অধিদপ্তরে অভিযোগ করেও অনেক সময় প্রতিকার মিলছে না। আবার কোনো কোনো সেবা খাতে প্রতারিত হয়েও অভিযোগ করার সুযোগ থাকে না। এমনকি মামলার সুযোগও থাকে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থদণ্ডের বদলে অপরাধীদের কারাদণ্ড দিতে হবে। সে জন্য আইন সংশোধন জরুরি। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে  অধিদপ্তরের জনবল ও প্রশাসনিক ক্ষমতা।

টাকার বিনিময়ে মানসম্পন্ন নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত পণ্য এবং সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে ভোক্তার। একই সঙ্গে অধিকার রয়েছে পণ্যের উৎপাদান, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, বিক্রয়মূল্য, পণ্যের মান ও কার্যকারিতা বিষয়ে জানার। তবে বেশিরভাগ মানুষ এসব সেবা থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে খাদ্য, ভোগ্যপণ্য, ওষুধ, চিকিৎসা, গণপরিবহন, ওজনে কারচুপির শিকার হচ্ছেন ভোক্তারা।

এমন পটভূমিতে প্রতিবছরের মতো এবারও দেশজুড়ে আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। ১৯৮৩ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। বিশ্বের ১১৫ দেশে ২২০টি ভোক্তা অধিকার সংগঠন দিবসটি পালন করে থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘নিরাপদ জ্বালানি, ভোক্তাবান্ধব পৃথিবী’। দিবসটি উপলক্ষে কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যায়ে ক্রোড়পত্র ও স্মরণিকা প্রকাশ, ভোক্তাদের খুদে বার্তা পাঠানো, শোভাযাত্রা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ নামে একটি আইন হয়। আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো, ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ প্রতিরোধ, অধিকার লঙ্ঘনজনিত বিরোধ নিষ্পত্তি, নিরাপদ পণ্য ও সঠিক সেবা নিশ্চিত করা, ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, পণ্য ও সেবা ক্রয়ে প্রতারণা রোধ ও গণসচেতনতা তৈরি করা।

তবে যথেষ্ট প্রচার-প্রচারণার অভাবে মানুষ এ আইন ও এর সুফল সম্পর্কে জানে না। অন্যদিকে, অভিযোগ এলেও অধিদপ্তরে প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অনেক মামলার সুরাহা করা যাচ্ছে না ভোক্তা অধিকার আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে।

গতকাল মঙ্গলবার লক্ষ্মীপুরের মামুনুর রশিদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি একটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স করেছি। মেয়াদ শেষে বীমা দাবি পরিশোধের জন্য আবেদন করেছি। তবে গত পাঁচ মাসে বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও জমা টাকা ফেরত পাচ্ছি না। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে ভোক্তা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করলেও আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে অভিযোগ করতে পারিনি।’

সংশ্লিষ্টরা বলেন, আইনে ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করলে মামলা করা যাবে বলা আছে। তবে সুস্পষ্টভাবে বলা নেই, কীভাবে বা কোন পদ্ধতিতে মামলা করা যাবে। এ ছাড়া অভিযোগকারী সরাসরি আদালতে মামলা করতে পারবেন না। তাঁকে অধিদপ্তরে মামলা করতে হবে। আইনটি প্রায় ১৪ বছর আগের। ওই সময়ের চেয়ে এখন অপরাধের মাত্রা যেমন বেড়েছে, তেমনি অপরাধের ধরনও পাল্টেছে। তবে নতুন নতুন অপরাধের বিষয়গুলো আইনে যুক্ত না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। যেমন– এক যুগ আগে ই-কমার্স ছিল না। এটি তখন আইনে যুক্ত হয়নি। ফলে ২০২১ সালের জুনের পর থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। আইনের সীমাবদ্ধতায় অনেক মামলার সুরাহা করা যাচ্ছে না। যেমন– ই-কমার্স খাতে এখনও ১২ হাজার মামলা ঝুলে আছে। ভোক্তারাও প্রতিকার পাচ্ছেন না।

দ্রুত আইন সংশোধনের পরামর্শ ক্যাবের: এ ব্যাপারে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আইনের প্রথম অধ্যায়ের ২২ নম্বর ধারায় ব্যাংক-বীমা, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইনে কেনাকাটা, আর্থিক লেনদেনসহ অন্যান্য আর্থিক ‘সেবা’ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ ছাড়া বোর্ডিং, বাসা বা স্থান ভাড়া, ইন্টারনেট, ইলেকট্রনিক ও বৈদ্যুতিক আইটেম, ই-কমার্স, ডাক, কুরিয়ার সার্ভিসসহ কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এভাবে বেশ কয়েকটি ধারায় দুর্বলতা রয়েছে। এগুলোর সংশোধন জরুরি।

তিনি বলেন, বাজারে অভিযান জোরদার করার পাশাপাশি ভোক্তাদের সচেতনতায় প্রচারণা বাড়াতে হবে। আইন সংশোধনের পাশাপাশি বাড়াতে হবে অধিদপ্তরের লজিস্টিক সহায়তা ও জনবলের সক্ষমতা। বর্তমানে এক কর্মকর্তাকে একাধিক জেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, বিদ্যমান আইনে যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো মন্ত্রিপরিষদে পর্যালোচনার পর অধিদপ্তরে এসেছে। আরও কিছু সংযোজন-বিয়োজনের পর চূড়ান্ত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আইন সংশোধন করা হলে সেখানে ই-কমার্স নামে একটি আলাদা অধ্যায় রাখা হবে। এ ছাড়া সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে অপরাধের মাত্রার চেয়ে জরিমানা নগণ্য। তাই জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে।

মামলার ব্যাপারে তিনি বলেন, মামলা করতে হয় ফৌজদারি আইনে। সিটি করপোরেশন বা মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরে নিজস্ব ইন্সপেক্টর রয়েছে। তাঁরা মামলা করতে পারেন। তবে ভোক্তা অধিদপ্তর সেটি করতে গেলে সমস্যা আছে। কারণ যিনি বিচার করবেন, তিনি কীভাবে মামলা করবেন। অধিদপ্তর তো বিচার করার জন্য গঠন করা হয়েছে। তবে ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৫৩টি মামলা করেছে। এ ছাড়া ডিমের দামে কারসাজি করায় অধিদপ্তর নিজেই সিআইডিতে একটি মামলা করেছে। তবে মাত্র ২১৬ জন লোকবল দিয়ে ১৭ কোটি ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন।

ভোক্তাদের যত অভিযোগ : ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে বাজার পর্যবেক্ষণ, অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি শুরু করে অধিদপ্তর। ওই সময় থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮৮ হাজার ৯১৮টি অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এর সিংহভাগই হলো অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের বিরুদ্ধে। মোট অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৩ হাজার ৭৯৮টি। অনিষ্পন্ন রয়েছে ১৭ হাজার ১২০টি। অভিযোগের ভিত্তিতে ৮ হাজার ৩২৮টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৮ হাজার ৮০৮ টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ হিসাবে অভিযোগকারীদের দেওয়া হয় ১ কোটি ৪৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫৭৭ টাকা। বাকি ৭৫ শতাংশ অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ছাড়াও সংস্থাটি স্বউদ্যোগে বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালায়। এ পর্যন্ত ৬২ হাজার ৯টি অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬০টি প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনা হয়।

যেভাবে করবেন অভিযোগ: ভুক্তভোগীকে অবশ্যই অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করতে হবে। ফ্যাক্স, ই-মেইল, ওয়েবসাইট বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমেও অভিযোগ জানানো যায়। অভিযোগের সঙ্গে অবশ্যই সেবা বা পণ্য কেনার রসিদ যুক্ত করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে (http://dncrp.portal.gov.bd) ‘জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্র’ বক্স থেকে নির্ধারিত অভিযোগ ফরম ডাউনলোড করে নেওয়া যায়। এ ছাড়া যে কোনো স্থান থেকে ১৬১২১ নম্বরে ফোন করে জানানো যাবে অভিযোগ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.