পাথরের অভিনব জাদুঘর

0
126
পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে পাথরের জাদুঘরটি গড়ে উঠেছে দোতলা একটি ভবনে। সম্প্রতি তোলা ছবি

রকস ভবন। কিছুটা দূর থেকেই দোতলা ভবনটির এই নাম আলাদা করে চোখে পড়ে। তবে নামটি চোখে পড়ার আগেই এই নামের একটা অনুভূতি পেয়ে যেতে বাকি থাকে না কারোরই। সামনে সাজিয়ে রাখা বড় আকৃতির কিছু পাথর নীরবে জানিয়ে দেয় এই ভবনটির উদ্দেশ্য।

আমরা এসেছি দেশের সবচেয়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের রকস মিউজিয়ামে। জেলা শহরের পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে পাথরের জাদুঘরটি গড়ে উঠেছে দোতলা একটি ভবনে।

ভবনের নিচতলার বড় কক্ষটিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা সময়ে সংগ্রহ করা নানা আকার আর রঙের দুর্লভ কিছু পাথর। লম্বাটে, গোলাকার; সাদা, হলুদ, কালো। পাথরের পাশাপাশি অন্যান্য আরও কিছু সংগ্রহও আছে। আছে প্রাচীনকালের মূর্তি, টেরাকোটা বা পোড়ামাটির নকশা, প্রাচীন মুদ্রা। দৃষ্টি আকর্ষণ করে শালগাছের মাঝখানে খোদাই করে তৈরি প্রায় তিন শতক প্রাচীন দুটি নৌকা।

কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নাজমুল হক ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে জাদুঘরটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল দর্শনার্থীরা যাতে এখানে এসে এ অঞ্চলের ভূমির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারেন। তবে ঐতিহাসিক আরও নমুনাসামগ্রীও সংগ্রহ করেছেন ভূমি–বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি আমাদের নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্যগত পরিচয় তুলে ধরার জন্য।

কথা হলো নাজমুল হকের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘গবেষণা করতে গিয়েই আমার পাথর সংগ্রহের শুরু। কালক্রমে সেটিই জাদুঘরে রূপ নেয়। এখানে সংগৃহীত পাথরগুলো এই অঞ্চলে বসবাসকারী প্রাচীনকালের সাক্ষী।’

পঞ্চগড়ের নদী আর ভূগর্ভের নুড়িপাথরের কালানুক্রমিক নমুনা নিয়ে সাজানো হয়েছে জাদুঘরটি। ভূমির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার জন্য এখানে যেমন আছে বিচিত্র আকৃতি, রং ও বৈশিষ্ট্যের আগ্নেয় ও পাললিক শিলা, হালকা ও গাঢ় হলুদ বালি, খনিজ বালি, সাদামাটি ও কঠিন শিলার পাশাপাশি সামুদ্রিক ঝিনুক ও শঙ্খ; তেমনই ইতিহাসের নমুনা হিসেবে আছে শত শত বছরের পুরোনো ইমারতের ইট, পাথরের মূর্তি আর পোড়ামাটির নকশা। এ অঞ্চলের জীবনযাত্রার কথা বলে নানা রকমের মৃৎপাত্র, মাটির কূপের জন্য ব্যবহৃত রিং, ব্রিটিশ আমলের মাইলফলক।

প্রদর্শনীর বেশির ভাগ পাথর ভিতরগড় দুর্গনগরী এবং এর আশপাশের অঞ্চল থেকে সংগৃহীত। জনশ্রুতি আছে, দেড় হাজার বছর আগে ভিতরগড় ছিল পৃথু রাজার রাজধানী। জাদুঘরটি আয়তনে ছোট হলেও এর দুর্লভ সংগ্রহে মুগ্ধ হন দর্শনার্থীরা।

এখানে একটি জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে আছে এ অঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ব্যবহৃত বস্তু—কালনাগ, মনসার পিতলমূর্তি, বিষোহরির মূর্তি, বিষ্ণু-গণেশের মূর্তি, ধাতবপাত্র, প্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপ, পিঁপড়ার বাসার জীবাশ্ম, হুলির গানে ব্যবহৃত ঢোল, সাঁওতালদের ব্যবহৃত ধূম্রদব্য সাকামচুকি, পাথরের বাটি। আরও চোখ কাড়ে মোগল সৈনিকদের তরবারি।

হেমন্তের এই সময়ে পঞ্চগড়ের আকাশে মেঘ বা কুয়াশা থাকে না। তখন তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার শোভা উপভোগ করা যায়। এই শোভা দেখতে সাম্প্রতিককালে পর্যটকদের পদচারণ বেড়েছে। সেই পর্যটকেরা রকস মিউজিয়ামও উপভোগ করে আসছেন। নাজমুল হক বলেন, এ কারণে জাদুঘরটি আরও আকর্ষণীয় করে তোলা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

জাদুঘরটি বর্তমানে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অধীনে। জাদুঘর পরিচালনার জন্য কিউরেটরের অভাব চোখে পড়ে। বহুমূল্যবান প্রদর্শনসামগ্রী কলেজ প্রাঙ্গণে উন্মুক্ত। প্রদর্শনীর ব্যবস্থায়ও পেশাদারির ঘাটতি।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজির হোসেন মিঞা জানালেন, এই জাদুঘরের জন্য সরকারি কোনো অনুদান নেই। দর্শনার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি পাওয়া ১০ টাকার সঞ্চয় দিয়েই জাদুঘরটির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে।

এলাকার বিশিষ্টজনেরা বলছেন, অমূল্য এসব সংগ্রহ সংরক্ষণ করা এবং দর্শনার্থীবান্ধব করে প্রদর্শনযোগ্য করে তোলার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলামও এ বিষয়ে দ্বিমত করেননি। তিনি বললেন, পঞ্চগড়ের পর্যটনের ক্ষেত্রে রকস মিউজিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জাদুঘরের আধুনিকায়নের মাধ্যমে এটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে জেলা প্রশাসনের।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.