বিশু মিয়ার বয়স এখন দুই বছর। মানিকগঞ্জ থেকে ট্রাকে করে ঢাকায় এসেছে মঙ্গলবার দুপুরে। উত্তরা দিয়াবাড়ির বউবাজার হাটের মাঝখানে অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিশু। মাথায় লাল–হলুদ কাপড়ের তাজ লাগানো হয়েছে। গলায় জরি কাপড়ের হলুদ রঙের মালা। এমনিতেই বিশুর মিশমিশে কালো রং আর সবল গঠনে ওকে সুন্দর দেখায়। এর ওপর সাজগোজ করায় জ্বলজ্বল করছিল।
গরু তো বিক্রির জন্যই আনা হয়েছে, তাহলে এত সাজগোজ দরকার কেন, জানতে চাওয়া হয়েছিল ব্যাপারী আবদুল মান্নানের কাছে। মেজাজি বিশুকে সামলাতে সামলাতে তিনি বললেন, ‘প্রিয় জিনিস সুন্দর দেখতে মন চায়। বিশু আমার খুব আদরের। বিক্রি তো কইরাই দিব। তাই সাজায় দিছি ওরে।’
এবার প্রায় সোয়া কোটি কোরবানির পশু প্রস্তুত
লাল, কালো, সাদা বা বাদামি–রং যেমনই হোক, কোরবানির পশুটি একটু সাজিয়ে দিলে যেমন চোখে পড়ে, তেমনি উৎসবের আমেজটা আরও রঙিন হয়। রাজধানীর বিভিন্ন কোরবানির পশুর হাটের বাইরে, ভেতরে সেসব সাজসজ্জার দোকান বসেছে। এসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে কাপড় ও জরি দিয়ে তৈরি মালা ও ফিতা, গলার ঘণ্টা, বেল্ট। মাথা ও শিঙে পরানোর ফুল, গলা ও পায়ের ঘুঙুর। বিভিন্ন রঙের দড়িসহ সাজানোর সব ধরনের সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। অস্থায়ী দোকানের পাশাপাশি আছে ফেরিওয়ালাদের দোকান।
গ্রিক প্রবাদ আছে, সৌন্দর্য থাকে দর্শকের চোখে। বিভিন্ন পশুর হাটের ব্যাপারী আর ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা কোরবানির পশু সাজান দুটি কারণে। নিজেদের দেখতে ভালো লাগে আর সাজানো হলে সেই পশুর প্রতি ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করে।
কোরবানির পশুর সাজসজ্জার বিক্রি ঘিরে ঈদুল আজহার সময় রীতিমতো ব্যবসা জমে ওঠে। নারায়ণগঞ্জের মোহাম্মদ এরশাদ দিয়াবাড়ির বউবাজারে এসেছিলেন পাঁচ হাজার টাকার পসরা নিয়ে। সোমবার এসে মঙ্গলবার পর্যন্ত এক দিনে বিক্রি করেছেন দেড় হাজার টাকার জিনিসপত্র। তিনি বলেন, ব্যাপারীদের চেয়ে কোরবানির পশুর ক্রেতারাই বেশি কেনেন এসব জিনিস। গলায় মালা পরিয়ে নিয়ে যান বাড়ি। ক্রেতার সঙ্গে শিশুরা থাকলে ওদের নাকি সাজসজ্জার জিনিস কেনার আবদার বেশি থাকে।
দিয়াবাড়ির বউবাজার ঘুরে দেখা গেল, অন্তত ২০টি ভ্রাম্যমাণ দোকান আছে এক হাটে। কমবেশি পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার টাকা মূলধন সবার। কাগজ, কাপড় আর জরির মালার চাহিদা বেশি। কেউ কেউ ঘণ্টা কেনেন একটু বেশি দামে। গরুর মাথায় পরানোর জন্য কাপড়ের তাজে আঁকা থাকে চাঁদ–তারার নকশা। কয়েকটি গরুর পিঠের কুঁজে মালা পরানো ছিল। এতে ওই পশুর দাম আরও বাড়বে বলে বিশ্বাস কিশোরগঞ্জ থেকে আসা মালেক ব্যাপারীর। তাঁর বাদামি গরু বাদশাহর পিঠের কুঁজ হচ্ছে গর্বের ব্যাপার। তাই সেখানে মালা দিয়ে আরও দৃশ্যমান করেছেন। বাদশাহর দাম ধরেছেন আড়াই লাখ টাকা। ৩০০ টাকার সাজসজ্জা কেনা হয়েছে বাদশাহর জন্য। তবে গরুর হাটে একটি মজার ব্যাপার আছে নাম নিয়ে। অধিকাংশ গরুর নাম বাদশাহ, কালা পাহাড় বা ধলা পাহাড়। আরেকটি গোপন সাজও আছে গরুর। তাদের শিংয়ে শর্ষের তেল মাখানো হয়। এতে শিং চকচক করে।
বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে টঙ্গী থেকে উত্তরার হাটে ছাগল কিনতে এসেছিলেন আবদুর রহিম। ১৮ হাজার টাকা দিয়ে কেনা সাদা ছাগলটির গলার দড়ি ধরে কাদার ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর ১০ বছরের ছেলে। আবদুর রহিমের সঙ্গে দেখা একটু দূরেই সাজসজ্জার পণ্যের দোকানে। তিনি বলেন, ছেলের আবদার। ছাগলের জন্য লাল মালা লাগবে। কিন্তু এই হাটে মালা পাওয়া যাচ্ছে সাদা, সবুজ, হলুদ আর গোলাপি রঙের। টকটকে লাল মালা নেই। এক দিন পরেই কোরবানি করে দিতে হবে, এখন সাজিয়ে কী হবে জানতে চাইলে বলেন, প্রিয় জিনিসই তো কোরবানি করার নিয়ম, তাই না? কেনার পর থেকেই ক্রেতার কিন্তু মায়া জন্মে যায় পশুটির জন্য। সাজালে ভালো লাগে দেখতে।
ত্যাগের পশুকে এভাবে সাজিয়ে যেন উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ হয়।