পদে পদে অব্যবস্থাপনা, রোগীর নাভিশ্বাস

ডেঙ্গুতে এত মৃত্যুর দায় কার

0
149
ডেঙ্গু মশা

ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকার নানা প্রস্তুতির কথা বললেও বাস্তবে এর তেমন প্রতিফলন নেই। হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হলেও নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। আক্রান্তদের আলাদা রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না। এদিকে চিকিৎসা উপকরণের ঘাটতি দেখা দিয়েছে; দামও অনেক বেড়েছে। হাসপাতালগুলোতে প্লাটিলেট সরবরাহ নিশ্চিতে নির্দেশনা দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এ মৌসুমে ডেঙ্গুতে এক লাখের বেশি আক্রান্ত এবং পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও ডেঙ্গু কর্নার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বেসরকারি অনেক হাসপাতালে কিট সংকটের কারণে প্লাটিলেট সরবরাহের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। শুরু থেকেই তিন স্তরে রোগী ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়ার কথা বললেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেই। রোগীর জন্য মশারি ব্যবহারও নিশ্চিত করা হয়নি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগীর প্রকৃত অবস্থা জানতে ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে দ্রুত ধরন (সেরোটাইপ) নির্ণয়ে বড় ধরনের গবেষণা জরুরি। রোগীর আলাদা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব কোথায়, কেমন কিংবা এই ভাইরাস বহনে কত শতাংশ মশা সক্ষম– তা জানা প্রয়োজন। দ্বিতীয় পর্যায়ে (সেকেন্ডারি ভেক্টর) নিধন কার্যক্রম কতটা সফল হচ্ছে, এ নিয়ে গবেষণায় ঘাটতি দেখছেন তারা।

বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমরা এখনও জানি না, কোন এলাকা মশার উৎপত্তিস্থল। এ ছাড়া প্রত্যন্ত গ্রামে যে দুই ধরনের মশা আছে, তা কী মাত্রার– এ নিয়েও কোনো গবেষণা নেই। আমাদের কোনো সুপারিশকে সরকার গুরুত্ব দেয়নি। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে মশা নিধন কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা বললেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। নির্ধারিত জায়গা নির্বাচন করে বছরব্যাপী ওই সব জায়গায় মশা ও লার্ভার প্রকৃত অবস্থান জানার গবেষণার পরামর্শ দেওয়া হলেও এটা করা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে গবেষণা করে, সেটা মূলত ম্যালেরিয়া জীবাণুবাহী মশার ব্যাপারে করা হয়; ডেঙ্গুর জন্য নয়।

জানুয়ারি থেকে মশা নিধনের কার্যক্রমে জোরদার পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তবে বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। মশা নিধন কার্যক্রমে দুর্নীতি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিটিআই জালিয়াতি তার প্রমাণ।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, ২৩ বছরে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব হয়নি। রোগ নিয়ন্ত্রণে বা পরিধি জানতে বড় কোনো গবেষণা করা হয়নি। মহামারি নিয়ন্ত্রণে সে রকম কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে তা কার্যকর কিনা, সেটি প্রমাণ করা হয়নি। দেশজুড়ে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার কমাতে বিকল্প চিন্তা করার সময় এসেছে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকেই প্রস্তুতি ও পদক্ষেপের ঘাটতি রয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রণ ততটা গুরুত্ব পায়নি। মহামারির মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেও মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। এখনও সামাজিক সম্পৃক্ততা নেই। এটা আমাদের বড় ব্যর্থতা। এখন গ্রাম পর্যন্ত ডেঙ্গু চলে গেছে। এতে বিপদ বাড়বে। ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে সামাজিক সম্পৃক্ততা জোরদার করতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশন। বিশেষ করে ঢাকার দুই মেয়র এই দায় এড়াতে পারেন না। ঢাকার বাইরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ডেঙ্গু নিধন নিয়ে কোনো কার্যক্রম নেই। যে কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সুপারিশও উপেক্ষিত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। এ ছাড়া গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তবে আইইডিসিআর পরিচালক তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘আমাদের সব ধরনের ভাইরাস নিয়ে কাজ করার সক্ষমতা আছে। ডেঙ্গু নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। ঢাকার বাইরেও গবেষণা চলছে। বড় গবেষণার জন্য জনবল আর ল্যাবরেটরি বাড়াতে হবে।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সঠিকভাবে রোগী ব্যবস্থাপনার জন্য হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শয্যা বাড়ানো হয়েছে। রাতারাতি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ানো সম্ভব নয়। ডেঙ্গু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ ফেললেও এর বাহক এডিস মশা নিধনের কাজ স্বাস্থ্য বিভাগের নয়; এই দায়িত্ব মূলত স্থানীয় সরকার বিভাগের। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেখানে এই মশার জন্ম হয়, সেখানে স্প্রে করে লার্ভা ধ্বংস করতে হবে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা আছে; তাদের পরামর্শ দিয়েছি এই প্রোগ্রাম সারাবছর চালাতে।

তবিবুর রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.