পণ্যমূল্যের দৌড়ে পিছিয়ে মজুরি

0
200
মে দিবসে সবার ছুটি থাকলেও অনেক শ্রমিকই এই দিনেও কাজে যেতে বাধ্য হন। সব শ্রমিকের হোক এই দিবস

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, মজুরি সে হারে বাড়ছে না। গত বছরের মার্চে যে পণ্যটি ১০০ টাকায় কেনা যেত এখন তা কিনতে ১০৯ টাকা ৩৩ পয়সা লাগছে। মূল্যস্ফীতি আগের মাসের চেয়ে বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে এসে ঠেকেছে। অথচ বিবিএসের মজুরি হার সূচক বলছে, ওই মার্চে জাতীয়ভাবে গড়ে মজুরি বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ মজুরির চেয়ে দাম বাড়ছে ২ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে।

গত এক যুগের মধ্যে বাজারে জিনিসপত্রের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে। সেটিই মূল্যস্ফীতির বর্তমান রেকর্ড। মাসটিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছে। অথচ ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ৮০ শতংশ। অর্থাৎ, এক বছর আগে যে মজুরি ছিল ১০০ টাকা তা বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা ৮০ পয়সা। ফলে শ্রমিকের এখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। বাকি মাসগুলোতেও মজুরি আর মূল্যস্ফীতির ফারাক বাড়ছে বই কমছে না।

এদিকে গত ২৯ মার্চ প্রকাশিত জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা জরিপের ফল বলছে, দেশের ৩০ শতাংশ পরিবার এখন ঋণ করে চলছে এবং গত ছয় বছরে ঋণ করার গড় পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণের মতো বেড়েছে।

১০ জন শ্রমিক ও শ্রমিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কষ্টে আছেন সাধারণ শ্রমিকরা। ধারদেনায় চলছে সংসার। প্রয়োজনীয় অনেক ব্যয় কমিয়ে সামাল দিতে হচ্ছে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি। খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদাও কাটছাঁট করে দিন চালাতে হচ্ছে। শ্রমিকদের জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনা হলো মূল্যস্ফীতি আর মজুরির এই ব্যবধান।

মজুরি সূচক নির্ধারণে কম মজুরির দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের কর্মঘণ্টা কিংবা হাজিরাভিত্তিক দৈনিক আয়কে বিবেচনা করে থাকে বিবিএস। মাসিক কিংবা চুক্তিভিত্তিক আয়কে মজুরির হিসাবে ধরা হয় না। মজুরির হার নির্ধারণে কৃষি, শিল্প ও সেবা– বড় এ তিন খাতের ৪৪টি পেশাকে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে কৃষি খাতের পেশা ১১টি, শিল্পের ২২টি ও সেবা খাতের ১১টি পেশা রয়েছে। এসব খাতের বাইরে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হলো তৈরি পোশাকশিল্প। এ খাতের শ্রমিকদের আয়ও গড় মূল্যস্ফীতির নিচে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা নিম্নতম মজুরি বোর্ডের প্রকাশিত গেজেটে এ খাতে বছরে আয়বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির প্রায় অর্ধেক; মাত্র ৫ শতাংশ।

পেট্রোল পাম্প শ্রমিকদের মাসিক মজুরি ৭৯২ টাকা। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মজুরি নির্ধারণ করে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, পেট্রোল পাম্প শ্রমিকদের মাসিক মজুরি ৭৯২ টাকা। এর মধ্যে যাতায়াত ভাতা ২০ টাকা; বাড়ি ভাড়া ১১২ টাকা; চিকিৎসা ভাতা ১০০ টাকা ও মূল মজুরি ৫৬০ টাকা। ১৯৮৭ সালে এই মজুরি নির্ধারণ করা হয়। এরপর আর মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়নি। অবশ্য হাল ছেড়ে দেয়নি মজুরি বোর্ড। মজুরি পুনর্নির্ধারণ প্রক্রিয়া চলমান। টাইপ ফাউন্ড্রি শ্রমিকদের মজুরি আরও কিছুটা হাস্যকর। ৯৬ টাকা বাড়ি ভাড়াসহ মাসিক মোট মজুরি ৫২১ টাকা, যা দিয়ে বড়জোর পোলট্রি মুরগির দুই কেজি মাংস কেনা সম্ভব। মজুরি বোর্ড গত ১২ এপ্রিল এসব তথ্য হালনাগাদ করেছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ বলেন, পেট্রোল পাম্প শ্রমিকদের মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তবে মালিকপক্ষের প্রতিনিধির অসহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত আর মজুরি ঘোষণার পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পেট্রোল পাম্পের মজুরি নির্ধারণে অতীতে গঠিত বোর্ডের মালিক প্রতিনিধি পদত্যাগের কৌশল নেন। বর্তমান বোর্ডের প্রতিনিধিও একই কাজ করছেন। তিনি এ পেশাকে শিল্প খাতই মনে করেন না। এ অবস্থায় মজুরি বোর্ড করণীয় নিয়ে ভাবছে।

কোনো শিল্পের সার্বিক অবস্থা, শ্রমিকদের জীবনযাপন ব্যয়, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত পণ্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি ও দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। এ জন্য মালিক, শ্রমিক ও নিরপেক্ষ প্রতিনিধির সমন্বয়ে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়।

তিন খাতের মজুরির চিত্র

শিল্প, নির্মাণ ও মৎস্য খাতের মজুরি গড় মজুরির চেয়েও কম। এ তিন খাতের মধ্যে মৎস্যজীবী শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। নির্মাণ খাতে ৫ দশমিক ৬৪ ও শিল্প খাতে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ হারে।

ন্যূনতম মজুরি নেই ৫৬ শিল্প খাতে

দেশে আনুষ্ঠানিক শিল্প এখন ১০৪টি। মজুরি বোর্ড মাত্র ৪৪টি শিল্পে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো করেছে। বাকি ৫৬ শিল্প এখনও ন্যূনতম মজুরির বাইরে রয়ে গেছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) সূত্রে জানা গেছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সংস্থার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়েছে ৫৪টি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে বিবিধ আকারে আরও ৫০টি শিল্প খাতকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে গার্মেন্ট শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনী বলেন, ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার পরও মালিকপক্ষ তা মানে না। যেখানে বোর্ডের ঘোষণা অনুযায়ী মজুরি দেয় না, সেখানে মজুরি কাঠামোর বাইরের শিল্পগুলো কীভাবে চলছে তা বুঝতে আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গেল ২৯ মার্চ প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ বলছে, বর্তমানে শ্রমশক্তিতে ৭ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ যুক্ত আছে। মোট শ্রমশক্তির মধ্যে কাজে নিয়োজিত রয়েছে ৭ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। অন্যদিকে শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে ৪ কোটি ৬৯ লাখ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল) নির্বাহী সদস্য শাকিল আক্তার চৌধুরী বলেন, নিত্যপণ্যের দর বৃদ্ধির কারণে সংকটে আছে শ্রমিক সমাজ। মূল্যস্ফীতি যেহেতু এখন বিশ্ববাস্তবতা, সে কারণে দর কমানোর সুযোগ হয়তো নেই বা কম। তবে আয় বাড়ানোর মাধ্যমে সাধারণ শ্রমিকদের একটু ভালো রাখা যায়। শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে তাঁরা বিভিন্ন ফোরামে আবেদন জানিয়েছেন। জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনসহ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকদের জন্য রেশনিং চালু করার দাবি জানিয়ে আসছে গত কয়েক মাস ধরে। মজুরি বাড়ানোর দাবিও তুলেছে তারা।

আবু হেনা মুহিব

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.