বাংলাদেশের ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের তুলনায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কী ধরনের গুণগত পার্থক্য তৈরি হয়েছে, তা খোঁজার চেষ্টা করছে সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। সেই সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ কতটা রয়েছে এবং দলগুলো অংশগ্রহণ করবে কিনা, তা বোঝার চেষ্টা করছে প্রতিনিধি দলটি।
গতকাল রোববার জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইইউ প্রতিনিধি দল।
বৈঠক সূত্র জানায়, ইইউ প্রতিনিধি দলের মূল আগ্রহ ছিল বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। তারা বাংলাদেশের আগের নির্বাচনগুলো মূল্যায়ন করেছে। তারা জানতে চেয়েছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন কেন ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে, বর্তমানে পরিস্থিতির এমন কী গুণগত পরিবর্তন হয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে।
বৈঠক শেষে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে কী অবস্থা ছিল আর এখন কী অবস্থায় রয়েছে, তা জানতে চেয়েছে প্রতিনিধি দল। সেই সঙ্গে লজিস্টিকস চ্যালেঞ্জগুলো কী, নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কিনা, অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হলে কী করতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জগুলো কী– এ ধরনের বিষয়গুলো তারা মূলত খুঁজেছে।
আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের আদলে নির্বাচন আর হবে না। দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলে তারা না এলে কী হবে। আর দল হিসেবে বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে তাতে পর্যবেক্ষক পাঠানো আইনসিদ্ধ হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
ড. কলিমুল্লাহ বলেন, ইইউর অনুসন্ধানী দলটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং নির্বাচন-পূর্ব পরিবেশ মূল্যায়ন করতে চাচ্ছে। তারা বিগত সব ক’টি জাতীয় নির্বাচনের পর্যালোচনা করেছে। অনুসন্ধানী দল নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তাঁর মতে, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন করাও চ্যালেঞ্জ।
তিনি জানান, দেশীয় পর্যবেক্ষকদের অভিজ্ঞতাও তারা জানতে চেয়েছে। আমি বলেছি, গত পাঁচটি সিটি নির্বাচন ও উপনির্বাচন সুষ্ঠু করার অভিজ্ঞতা আছে নির্বাচন কমিশনের। ইসির নির্বাচন সুষ্ঠু করার সক্ষমতা রয়েছে বলে জানিয়েছি।
সকালে প্রথমেই বৈঠক করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবির। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তারা বর্তমান নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। আমি বলেছি, এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত। নির্বাচনের আগে ইইউর একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানো উচিত।
তিনি আরও বলেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়েও জানতে চায়। তাদের জানাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা একটি ছোট দল পাঠাতে পারে।
এর পর সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত প্রতিনিধি দলটি বৈঠক করে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, মানবাধিকার সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এটাই আমি প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছি।
আদিলুর রহমান বলেন, তারা গত দুটি নির্বাচন নিয়ে জানতে চেয়েছে। এর সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচনের গুণগত কী পার্থক্য তৈরি হয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করেছে। বলেছি, আগে বৈশ্বিক অগ্রাধিকার ছিল ‘ওয়ার অন টেরর’ বা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তখন মানবাধিকার বিশ্বের কাছে অগ্রাধিকার ছিল না। ফলে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে অগ্রাধিকার হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার।
এর পর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, দেশের অবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক কিনা তারা জানতে চেয়েছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমি কোনো প্রস্তাব দিইনি। তবে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছি নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা সঠিক হতে হবে। মানুষের বিকল্প বেছে নেয়ার স্বাধীনতা যেন থাকে, পুরো প্রক্রিয়াটা যেন স্বচ্ছ হয়, কোনো রকম কারসাজি যেন না হয়, সেটা বলেছি। এসব প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
ড. বদিউল আলম বলেন, গত দুটি নির্বাচন থেকে আগামী নির্বাচনে শিক্ষণীয় কী রয়েছে, তা জানতে চেয়েছে প্রতিনিধি দল। ভোটার তালিকা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, সাংবিধানিক কাঠামো– মোট কথায়, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রয়োজনীয় বিষয়াদি জানতে চেয়েছে তারা।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রতিনিধি দল নিরপেক্ষ, অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন কীভাবে হতে পারে, তা জানতে চেয়েছে। সেই সঙ্গে এ বিষয়ে জনগণের মতামত কী রকম, তাও জানতে চেয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচন অংশ না নেয়, তাহলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। আর জনগণও নিরাপদ পরিবেশে ভোটে অংশ নিতে চায়। ইইউ বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, তাদের বড় অঙ্কের বাণিজ্য রয়েছে। বাংলাদেশে অনেক অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। ফলে এ অগ্রগতিকে এগিয়ে নিতে গণতান্ত্রিক উত্তরণের ব্যবস্থা শান্তিপূর্ণ হওয়া দরকার। এ জন্য ইইউ নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠালে ভালো হবে বলে প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গেও ইইউ প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। এ নিয়ে তিনি বলেন, প্রতিনিধি দল মূলত জানতে চেয়েছে বাংলাদেশে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কিনা। আর নির্বাচনের সময় বিচার বিভাগের কাছে মানুষ ন্যায় বিচার পায় কিনা। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর পর এর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগের বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল। তবে বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তবে এখনও বিচার বিভাগে অনেক ভালো নেতৃত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে এখনও নিউট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দিয়ে নির্বাচন করানো সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, বিআইপিএসএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ শাফকাত মুনির, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জয়নাল আবেদীন ফারুকও ইইউর প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন।
নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে রিকার্ডো চেলেরির নেতৃত্বে ইইউর ছয় সদস্যের একটি প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল গত ৮ জুলাই বাংলাদেশ সফরে এসেছে। তারা ২৩ জুলাই পর্যন্ত অবস্থান করবে। এ প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইইউ পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।