নিরাপত্তারক্ষীকে দিয়ে মৃত গ্রাহকের ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা তুলে নেন ব্যাংক কর্মকর্তারা

0
153
টাকা

ইসলামী ব্যাংকের কাকরাইল শাখার গ্রাহক মোহাম্মদ সাঈদ মারা যান ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি। তখন তাঁর ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩৫ টাকা। সাঈদের মৃত্যুর আট মাসের মাথায় তথ্য গোপন করে তাঁর স্বাক্ষর নকল করে ওই ব্যাংক হিসাবে নতুন মুঠোফোন নম্বর সংযুক্ত করার আবেদন করেন রমজান আলী নামের এক ব্যক্তি। তিনি ইসলামী ব্যাংকের কাকরাইল শাখার একজন নিরাপত্তারক্ষী। তাঁর এ আবেদন যাচাই-বাছাই না করেই মৃত সাঈদের ব্যাংক হিসাবে রমজানের মুঠোফোন নম্বর যুক্ত হয়। এরপর ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ৩ নভেম্বরের মধ্যে রমজান আলী ইসলামী ব্যাংকের ‘সেলফিন’ অ্যাপ ব্যবহার করে ১ কোটি ৩৩ লাখ ১ হাজার ২০০ টাকা তুলে নেন।

জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের মৃত গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় রমজানের বিরুদ্ধে গত ১১ মে মামলা করে ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এর মাসখানেকের মাথায় রমজানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা দেন। ইসলামী ব্যাংকের কোন কোন কর্মকর্তার পরামর্শ ও সহযোগিতায় তিনি এই জালিয়াতি করেন, তা উঠে আসে তাঁর জবানবন্দিতে। রমজানের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে ৩ জুলাই ইসলামী ব্যাংকের কাকরাইল শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মো. অলিউল্লাহকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এ বিষয়ে পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দিন মিয়া বলেন, ইসলামী ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষী রমজান আদালতে বলেছেন, জালিয়াতির মাধ্যমে মৃত গ্রাহকের টাকা আত্মসাতে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তা অলিউল্লাহসহ দুজন। অলিউল্লাহ নিজেই ৫০ লাখ টাকা নিয়েছেন। অপর ব্যাংক কর্মকর্তাও ৫০ লাখ টাকা নিয়েছেন। বাকি ৩৩ লাখ টাকা নিয়েছেন রমজান।

ওসি সালাহউদ্দিন বলেন, এই জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত অপর ব্যাংক কর্মকর্তা পলাতক। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

তবে মামলায় গ্রেপ্তার দুজন আদালতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন।

মৃত গ্রাহকের কোটি টাকা যেভাবে আত্মসাৎ

মামলার কাগজপত্রের তথ্য এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক মোহাম্মদ সাঈদ মারা গেছেন, সেটি তাঁর ব্যাংক হিসাবে উল্লেখ ছিল। মৃতের ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি ৩৩ লাখের বেশি টাকা জমা থাকার তথ্য জানতেন গ্রেপ্তার ব্যাংক কর্মকর্তা অলিউল্লাহ। পরবর্তী সময়ে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা করেন অলিউল্লাহসহ আসামিরা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) থোয়াই চনু মার্মা বলেন, অলিউল্লাহ ও আরেকজন ব্যাংক কর্মকর্তা ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষী রমজানকে দিয়ে একটি মুঠোফোনের সিম কেনান। সেই মুঠোফোন নম্বর সংযুক্ত করার আবেদন করেন রমজান। গ্রাহক সাঈদ মারা যাওয়ার তথ্য জানার পরও ব্যাংক কর্মকর্তা অলিউল্লাহসহ দুজন কর্মকর্তা রমজানের আবেদন গ্রহণ করেন। এরপর রমজান ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন নামের অ্যাপে নিবন্ধন করেন। এরপর মৃত সাঈদের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলতে থাকেন। সাঈদের ব্যাংক হিসাব থেকে কবে কত টাকা টাকা রমজান উত্তোলন করেন, তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া গেছে।

শুধু রমজানের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা

মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংকের একজন নিরাপত্তারক্ষী মৃত গ্রাহকের কোটি টাকা তুলে নিলেও বিষয়টি জানাজানি হয় গত মার্চ মাসে। এরপর গত ৬ মার্চ নিরাপত্তারক্ষী রমজান ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বরাবর একটি লিখিত আবেদন দেন। তাতে রমজান বলেন, তিনিই মৃত সাঈদের স্বাক্ষর জাল করে সেলফিন অ্যাপ ব্যবহার করে টাকা তুলে নিয়েছেন। সেই টাকায় তিনি ১৫টি গরু ও জমি কেনেন। বাকি টাকা তিনি জুয়া খেলে নষ্ট করেন।

যোগসাজশ করে রমজানকে দিয়ে এই আবেদন দেওয়ানো হয়েছিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। পল্টন থানার ওসি সালাহউদ্দিন মিয়া বলেন, মৃত গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের দায় শুধু নিরাপত্তারক্ষীর ওপর চাপানো হচ্ছিল। সে কারণে ব্যাংকের পক্ষ থেকে করা মামলায় শুধু ওই নিরাপত্তারক্ষীকে আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেল, মৃত গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংকের কর্মকর্তা অলিউল্লাহসহ আরেকজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য মামলার বাদী ও ইসলাম ব্যাংকের সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার রনি বাবুর মুঠোফোনে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। এ মামলার কাগজপত্র জব্দ তালিকার সাক্ষী ও ইসলামী ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) আবদুল ওহাব বলেন, ব্যাংকের গ্রাহক মৃত সাঈদের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ইসলামী ব্যাংকের কাকরাইল শাখা থেকে বেশ কিছু কাগজপত্র জব্দ করেছে পুলিশ। জব্দ তালিকার অপর সাক্ষী ইসলামী ব্যাংকের কাকরাইল শাখার কর্মকর্তা তরিকুল মনিরও মৃত সাঈদের ব্যাংক হিসাব খোলার ফরম, মুঠোফোন নম্বর পরিবর্তনের কাগজপত্রও পুলিশের হাতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা থোয়াই চনু মার্মা বলেন, সংঘবদ্ধ একটি চক্র মৃত সাঈদের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষী রমজানকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই জালিয়াতির ঘটনায় রমজান ও অলিউল্লাহ ছাড়া অন্য যাঁরা জড়িত রয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনা হবে।

আসাদুজ্জামান

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.