জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছার অভাবেই মূলত আইনের খসড়াটি আলোর মুখ দেখছে না।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, আইনের খসড়াটির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।
শিক্ষাসংক্রান্ত সব আইন, বিধিবিধান, আদেশগুলো একত্রিত করে জাতীয় শিক্ষানীতির এবং সেটি বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ছিল। এ লক্ষ্যে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ২৪টি উপকমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়ন করা। এরপর অন্তত অর্ধশত বার এই আইনের খসড়া নিয়ে সভা হয়েছে। নানা জনের মতামত নিয়ে আইনের খসড়া প্রণয়ন করে সেটি একাধিকবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও পাঠিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিভিন্ন রকমের ‘ত্রুটি ও প্রশ্ন’ থাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ খসড়াটি ফেরত পাঠিয়েছে। আলোচনার পর আলোচনা হয়েছে, কিন্তু আইনটি হচ্ছে না।
পাঠ্যবই কেন ছাপতে চায় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ, কতটা বাস্তবসম্মত
কোচিং-নোট গাইড নিয়ে ঠেলাঠেলি
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ‘ছায়া শিক্ষার’ নামে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনকে বৈধতা দিয়ে করা আইনের খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিতর্কের মুখে সেটি ফেরত এনে আবার সংশোধনের উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। পরের বছর আবার কোচিং, প্রাইভেট ও সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধের বিধান রেখে আইনের খসড়া করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু শেষমেশ সেটিও চূড়ান্ত হয়নি। এরপর আবার পরামর্শক নিয়োগ করে খসড়াটি চূড়ান্ত করলেও আলোর মুখ আর দেখেনি। তবে, সর্বশেষ প্রস্তাবিত আইনে নোট-গাইড বন্ধ করা হলেও সরকারের অনুমোদন নিয়ে সহায়ক পুস্তক, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। অবশ্য, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সহায়ক পুস্তক কিনতে বা পাঠে বাধ্য করতে পারবেন না। এসব বই কিনতে বা পাঠে বাধ্য বা উৎসাহ দিলে, তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। নিবন্ধন নিয়ে কোচিং চালানোর সুযোগও রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত এই আইনে। তবে কোচিং সেন্টারে কোনো শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাতে পারবেন না। এ ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না।
এখন সরকারি পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে, যেহেতু জাতীয় শিক্ষানীতি হয়েছিল এক যুগেরও বেশি সময় আগে, তাই শুধু সেই নীতির বিষয়কে প্রেক্ষাপট ধরে আইন করলে তা বাস্তবসম্মত হবে না। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটের বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে আইনটি করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, এত দিন আগে হওয়া শিক্ষানীতি পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করা দরকার।
আইন না হওয়ায় উপেক্ষিত নীতিমালা
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আইন না হওয়ায় শিক্ষার অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। যেমন প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করাসহ জাতীয় শিক্ষানীতির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। আবার, আইন না থাকায় কোচিং-প্রাইভেটের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা আগের একটি নির্দেশনাকেও বছরের পর বছর ধরে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছেন অনেক শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের আগস্টে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা’ জারি করে বলেছিল সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার কোনো শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। এমনকি শিক্ষকেরা বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারেও পড়াতে পারবেন না। তবে দিনে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। আর সরকার-নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাস করানো যাবে। অভিভাবকদের সম্মতিতে তা করার সুযোগ আছে। তবে, এ জন্য কাউকে বাধ্য করা যাবে না।
রাজধানীর বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়ুয়া একাধিক অভিভাবকের অভিযোগ, বিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষক এমন একটি ‘অবস্থা’ তৈরি করেছেন তাতে করে ওই সব শিক্ষকের কাছে সন্তানদের প্রাইভেট না পড়িয়ে উপায় থাকে না। শ্রেণিকক্ষে যেসব শিক্ষক পড়ান তাঁদের অনেকের কাছেই আবার প্রাইভেট পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন ঠিক মতো পড়াশোনা হয় না। কোচিং–প্রাইভেট ছাড়া উপায় নেই। শিক্ষকেরাও পড়াচ্ছেন। কোনো তদারকি হয় না। অভিভাবকেরা এখন সম্পূর্ণ ‘জিম্মি’ হয়ে পড়ছেন। শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিচালনার কমিটির কাছে তারা জিম্মি। কেউ প্রতিবাদ করলে ব্যবস্থা তো হয়–ই না, বরং উল্টো যাঁরা অভিযোগ করেন, তাঁদের সমস্যায় পড়তে হয়। তাই তাঁরা চান সরকার আইন করে কোচিং বাণিজ্য ও নোট–গাইড বন্ধ করুক।
শিক্ষায় অনেক পরিবর্তন, মান বাড়ছে কতটা
কোচিং-প্রাইভেট, নোট গাইড ইত্যাদি কয়েকটি বিষয় থাকবে কি, থাকবে না—তা নিয়েই প্রস্তাবিত আইনটি আটকে আছে বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ। তবে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত আইনটি যেভাবে হচ্ছে সেটি তাঁর কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। বরং শিক্ষা অধিকার আইন হওয়া উচিত। যেখানে অধিকার, অর্থায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ ও সমতা ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে।
সদিচ্ছার ঘাটতি
সব মিলিয়ে শিক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনার পর আলোচনা আর পর্যালোচনা হয়েছে। গণমাধ্যমেও অসংখ্যবার সংবাদ হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি শূন্য।
জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে আইনটি করা জরুরি ছিল। কারণ, আইনটি না হওয়ায় শিক্ষার অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তিনি মনে করেন কোথাও না কোথাও সদিচ্ছার ঘাটতি থাকার কারণেই আইনটি এত দিনেও হয়নি।