ইয়াবা দিয়ে এক ছাত্রীকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়েছিলেন। সেই অভিযোগের তদন্তে নেমে ঘটনার সত্যতাও পেয়েছে বিভাগীয় তদন্ত দল। ছাত্রীকে ফাঁসানোর তদন্ত চলাকালেই অন্য এক আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে পকেটে পোরেন ২০ হাজার টাকা ঘুষ! একের পর এক অপকীর্তি চললেও বহাল তবিয়তে আছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ঢাকা মহানগর উত্তর বিভাগের গুলশান সার্কেলের উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ মো. সাজ্জাদ হোসেন।
সাজ্জাদের অপকর্মের বিষয়ে ডিএনসির উত্তর বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানলেও তাঁরা যেন মুখে কুলুপ এঁটেছেন! এত কিছুর পরও তাঁকে একই সার্কেলে একই পদে বহাল রাখায় খোদ ডিএনসির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীই প্রশ্ন তুলেছেন– সাজ্জাদের ক্ষমতার নাটাই কোথায়!
গত ৫ ডিসেম্বর ‘মাদক আইনের মারপ্যাঁচে মেধাবী ছাত্রী’ শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নজরে আসে। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব দিলশাদ বেগম ও ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) পরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি তানভীর মমতাজের সমন্বয়ে দুই সদস্যের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে তানভীর মমতাজ বলেন, গত ২৯ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবেদনের সত্যতা পাওয়ার কথা ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বলা হয়েছে– এজাহারনামীয় আসামির বিষয়ে তদন্ত করে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এজাহারে উল্লেখিত সময় এবং অভিযান চালানোর সময় ভিন্ন। এজাহার ত্রুটিপূর্ণ।
মেয়েটির বাসা ছিল রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে কুড়াতলী এলাকায়। তাঁর মা গৃহকর্মী, বাবা রাজমিস্ত্রি। প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ চালান ওই শিক্ষার্থী। কুড়াতলী এলাকার শীর্ষ মাদক কারবারি রায়হান তাঁর সন্তানকে প্রাইভেট পড়াতে বলেছিলেন ওই ছাত্রীকে। মাদক কারবারির সন্তানকে পড়াবেন না বলে জানিয়ে দিলে ওই তরুণীর ওপর ক্ষিপ্ত হন রায়হান। এর পর তাঁকে শায়েস্তা করতে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো হয়। ডিএনসির গুলশান সার্কেলের উপপরিদর্শক শেখ মো. সাজ্জাদ হোসেন গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তরুণীর বাসায় অভিযান চালান। তাঁর বাসা থেকে এক হাজার পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে উল্লেখ করে সাজ্জাদ বাদী হয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি খিলক্ষেত থানায় মামলা করেন। এতে সাক্ষী করা হয় দু’জনকে। একজন মাদক কারবারি ও একাধিক মামলার আসামি মামুন, অন্যজন তরুণীর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা রিপন। অবশ্য রিপন সে সময় জানিয়েছিলেন, তরুণীর কাছ থেকে ইয়াবা উদ্ধার করতে তিনি দেখেননি। আর মামুন মাদক কর্মকর্তা সাজ্জাদের সোর্স। এজাহারে বলা হয়, ডিএনসির উপপরিদর্শক রোকেয়া আক্তারের মাধ্যমে আসামির দেহতল্লাশি করা হয়। অথচ রোকেয়া সেদিন অভিযানেই ছিলেন না।
বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযানে কোনো নারীর শরীর তল্লাশি বা গ্রেপ্তারের সময় অবশ্যই নারী সদস্য উপস্থিত থাকার বিধান রয়েছে। অথচ এজাহারে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নারীর অনুপস্থিতিতে অভিযান চালানো ও তরুণীকে গ্রেপ্তারের ঘটনা সরাসরি আইন ও বিধির লঙ্ঘন। সাজ্জাদ ওই ছাত্রীর হাত ধরে নিচে নামানোর জন্য টানাহেঁচড়া করেছেন, যা নারীর প্রতি অবমাননা ও অধিকার খর্বের শামিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মামলার এজাহারে যেহেতু তরুণীর হেফাজত থেকে মাদক উদ্ধার করার বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়, সেহেতু ওই বাসায় থাকা তরুণীর মা-বাবাকে বাদ রেখে শুধু তাকেই কেন আসামি করা হলো, তা প্রশ্নবিদ্ধ। মামলার ২০ থেকে ২৫ দিন আগে রায়হানকে মাদকের গডফাদার বলেছিলেন আসামি তরুণী। যে কারণে রায়হানের লোকজন তাঁর মা-বাবাকে অপদস্থ ও তরুণীকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। দেখে নেওয়ার হুমকি ও পরবর্তী সময়ে হিংসাপরায়ণ হয়ে পরিকল্পিত মাদক মামলায় ফাঁসানোর বিষয়ে তরুণী ও সাক্ষীরা যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা সার্বিক বিবেচনায় যুক্তিসংগত মনে করেছে তদন্ত দল।
ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানায় করা মাদক মামলাটির তদন্ত আজও শেষ হয়নি। মামলাটি প্রথম তদন্ত করেন ডিএনসির উপপরিদর্শক রফিকুল ইসলাম। পরবর্তী সময়ে গুলশান সার্কেলের (তৎকালীন) পরিদর্শক নাজমুল হোসেন খানকে তদন্তভার দেওয়া হয়। তিনি সম্প্রতি বদলি হয়েছেন। তরুণী চার মাস জেল খাটার পর জামিনে বেরিয়ে আসেন।
ওই তরুণী বলেন, ‘উপপরিদর্শক সাজ্জাদ আমাকে ফাঁসিয়েছেন। আমি নির্দোষ।’ ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাঁর বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলাটির সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে খতিয়ে দেখার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে ডিএনসির মহাপরিচালক মো. আবদুল ওয়াহাব ভূঞার মোবাইল ফোন নম্বরে গতকাল মঙ্গলবার একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। পরে ডিএনসির পরিচালক (প্রশাসন) মো. মাসুদ হোসেনের মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। এর পর ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্ল্যাহ কাজলকে ফোন দিলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তরের উপপরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘সাজ্জাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রধান কার্যালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।’