দেশের যে ১০৮ এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হয়

0
188
বাংলাদেশ

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন তিন বছরব্যাপী গণমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার স্থানগুলো পর্যবেক্ষণ করে সারা দেশে ২২৯টি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করেছে। দুর্ঘটনার ধরন ও মাত্রা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ১০৮টিকে অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ ও ১২১টিকে সাধারণ দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করেছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘দেশের ২২৯টি এলাকার বাইরেও দুর্ঘটনা ঘটছে, তবে তা প্রতিনিয়ত নয়। মূলত, যেসব এলাকায় ধারাবাহিকভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে, সেসব এলাকাকে বিবেচনায় নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ বলতে যেসব এলাকায় কয়েক দিন পরপরই দুর্ঘটনার ঘটছে, সেসব এলাকাকে বিবেচনা করা হয়েছে। আর সাধারণ দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা বলতে যেখান কিছু বিরতিতে দুর্ঘটনা ঘটে, সেগুলোকে বোঝানো হয়েছে।’

অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। দুর্ঘটনার সংখ্যা ও এতে নিহত বা আহত ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া তথ্যে পার্থক্য থাকলেও দুর্ঘটনা বৃদ্ধির বিষয়টি স্পষ্ট।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণায় অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ যে ১০৮টি স্থানের তালিকা তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে সাত জেলায় সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ চারটি করে উপজেলায় দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয়। এ সাত জেলা হলো টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা। এই সাত জেলায় টাঙ্গাইলের উপজেলাগুলোর মধ্যে বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ ভূঞাপুর, কালিহাতী, ঘাটাইল ও মির্জাপুর। চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, পটিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলায় বেশি দুর্ঘটনা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চার দুর্ঘটনাপ্রবণ উপজেলার মধ্যে আছে সরাইল, নবীগঞ্জ, বিজয়নগর ও আখাউড়া। চিরিরবন্দর, বীরগঞ্জ, বিরামপুর ও ফুলবাড়ী—দিনাজপুরের এই চার উপজেলা অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। রংপুরের চার উপজেলা হলো পীরগঞ্জ, কাউনিয়া, পীরগাছা ও বদরগঞ্জ। ময়মনসিংহের চার উপজেলার মধ্যে আছে ভালুকা, গফরগাঁও, নান্দাইল ও ত্রিশাল। আর অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ কুমিল্লার চার উপজেলার মধ্যে আছে চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, ব্রাহ্মণপাড়া ও বুড়িচং।

সড়ক দুর্ঘটনা

কারণগুলো কী

যেসব এলাকায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে, তার সাতটি কারণ তুলে ধরেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো এলাকার সড়কের নকশা ও অবকাঠামোগত ত্রুটি। দ্বিতীয় কারণ হলো সড়কের পারিপার্শ্বিক বিরূপ অবস্থা।

এই ‘বিরূপ অবস্থা’ বলতে সাইদুর রহমান বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে সড়কে অস্বাভাবিক বাঁক থাকে। সড়কের পাশে বিশালকায় সাইনবোর্ডে আকর্ষণীয় ছবি থাকে। তাতে তাকিয়ে থেকে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া অনেক স্থানে রাস্তার ওপরেই ধান বা অন্যান্য ফসল শুকানোর প্রবণতা দেখা যায়। সেটাও একটা কারণ।

গবেষণায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত ব্যবস্থা না থাকা বা ঘাটতি (সাইন, মার্কিং, সড়ক বিভাজক, পূর্বসতর্কতামূলক নির্দেশনা বোর্ড) দুর্ঘটনার একটি কারণ। আবার যানবাহনের উচ্চগতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকা এবং একই সড়কে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের বাধাহীন ও বেপরোয়া চলাচলও দুর্ঘটনার নেপথ্যে কাজ করে।

সমস্যা আছে—এমন স্থানে যানবাহন চালনার ক্ষেত্রে চালকদের সক্ষমতার অভাব বা অদক্ষতা থাকলে দুর্ঘটনা ঘটে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। এ ছাড়া সড়কের পার্শ্ববর্তী বা সড়কঘেঁষা জনবসতি থাকলে তা দুর্ঘটনা ঘটাতে ভূমিকা রাখে।

দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকার সংখ্যা বেড়েছে

এর আগে ২০১৪ সালে ‘সড়কে নিরাপত্তা: বাস্তবতা এবং প্রতিবন্ধকতাসমূহ’ নামের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ২০০৯ সালের প্রায় ৫৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয়। ব্র্যাকের সহযোগিতায় এ গবেষণা করে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)। ওই গবেষণায় দেখা যায় দেশের পাঁচটি জেলা সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ। এগুলো হলো কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা।

পিপিআরসির গবেষণা ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৯ বছরে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকার সংখ্যা বেড়েছে ২০টি।

দুর্ঘটনা বন্ধে কী করা যায়

দুর্বল অবকাঠামোর কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই সড়কের যেসব স্থানে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে, সেসব স্থানের নকশা ও অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান করা দরকার বলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সুপারিশে উঠে এসেছে। এ ছাড়া তাদের দেওয়া সুপারিশের মধ্যে আছে সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত ঘাটতি নিরসন করা, যানবাহনের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার করা, একই সড়কে নানা ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধে সার্ভিস লেন অথবা সড়ক বিভাজক তৈরি করা।

রোড সেফটির ফাউন্ডেশনের আগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে কয়েক বছর ধরেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়ছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কিশোর-তরুণদের মৃত্যুর ঘটনা বেশি। গত বছরের (২০২২) জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে ২ হাজার ৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৯৭ জন। তার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দুর্ঘটনা ২১ শতাংশ এবং প্রাণহানি ১৯ শতাংশ বেড়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তাই এলাকার অপ্রাপ্তবয়স্কদের মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহন চালানো বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ উঠে এসেছে গবেষণায়। সেখানে আর যে দুটি সুপারিশ আছে, সেগুলো হলো সড়কের পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের মধ্যে নিরাপদে সড়ক ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন মনে করেন চালকের প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলা—এ দুটি বিষয় নিশ্চিত না করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না। মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘প্রশিক্ষণহীন চালকের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে। চালকের প্রশিক্ষণের প্রথম বিষয়টি হলো, সে নিরাপদে থামাতে পারবে কি না, এটি নিশ্চিত হয়ে গাড়ি চালানো। দেখা যায়, চালক সামনে ১০ মিটারও দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। ওভারটেক করছে। এর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। আবার মহাসড়কে ইজিবাইক, ঠেলাগাড়িসহ নানা ধরনের যান চলে। এভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনার এটাও বড় কারণ।’

মোয়াজ্জেম হোসেন মনে করেন, প্রশিক্ষিত চালক না রাখলে এবং সড়কে শৃঙ্খলা না ফেরালে বড় ধরনের কোনো উন্নতি আশা করা যায় না।

প্রশিক্ষিত চালকের যে অভাব আছে, তা স্বীকার করেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তবে তাঁর কথা, প্রশিক্ষিত চালক নয়, এমনিতেই চালকের বিপুল ঘাটতি রয়েছে। এনায়েত উল্লাহ এনা পরিবহনের মালিক। তিনি বলেন, নিজের পরিবহনে প্রশিক্ষক রেখে তিনি চালকদের প্রশিক্ষণ দেন। আবার জিপিএস চালু করে ২৪ ঘণ্টা চালকের গতিবিধি দেখা হয়। সব পরিবহনে এমন ব্যবস্থা নিলে দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘চালকের চাকরির অভাব নেই। কিন্তু চালকের অভাব ব্যাপক। তাই চাকরি চলে যাওয়ার ভয় তারা করে না। চালক প্রশিক্ষণে বিআরটিএ এবং বিআরটিসিকে দায়িত্ব নিতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।’

দেশে সড়ক-মহাসড়ক বিস্তৃত ও উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোটরযান চলাচল বাড়ছে, বাড়ছে গতি। এ কারণে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, এ ক্ষেত্রে সরকারকে একটি নিরাপদ ও টেকসই সড়ক পরিবহন–কৌশল প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নে কমিউনিটি পর্যায়ে মনোযোগ দিতে হবে। বেসরকারি সংগঠনগুলোকে এ কাজে অধিক মাত্রায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

পার্থ শঙ্কর সাহা

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.