দেশের বাণিজ্যে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, প্রবাসী আয়ে সৌদি আরব

0
146
বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার যেসব দেশ

গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির তুলনায় দেশটিতে রপ্তানি ছিল সাড়ে তিন গুণের বেশি। প্রবাসী আয়ের ১৬ শতাংশ দেশটি থেকে এসেছে।

অর্থনীতি এখনো নানা সংকটে। কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলারের দাম এখনো বেশি। বেড়েছে মূল্যস্ফীতির চাপ। এর মধ্যেও রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে সরকারকে। আবার একই সময়ে কমেছে আমদানি ব্যয়। এতেই চলতি হিসাবের ঘাটতি কমেছে এক-চতুর্থাংশ। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরেই দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি ছিল গত ৫১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারই বাংলাদেশের রপ্তানি আয়কে বাঁচিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে অবশ্য একক বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানই শীর্ষে।

অন্যদিকে প্রবাসী আয়ে বরাবরই শীর্ষে থাকত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। তবে দুই অর্থবছর ধরে এখন আরব আমিরাতকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের প্রবণতা বাকি সময়ে বজায় থাকলে শীর্ষ স্থানও দখল করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

মোস্তাফিজুর রহমান
মোস্তাফিজুর রহমান
আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ছয় বছর বাড়তি সুবিধা চাচ্ছি। সেটি যদি পেতে হয়, তাহলেও যুক্তরাষ্ট্রই বড় নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে।
মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি

বাংলাদেশ মূলত আমদানিনির্ভর দেশ। এখানে রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেশি। বাংলাদেশ মোট আমদানির প্রায় অর্ধেক করে চীন ও ভারত থেকে। ফলে যে বাণিজ্যঘাটতি হয়, তা পূরণ করতে হয় মূলত প্রবাসী আয় দিয়েই। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ছাড়াও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আর দুটি উৎস হচ্ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ। এই বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রেও শীর্ষ স্থানে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট পণ্য রপ্তানির ২০ শতাংশেরই গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ১৯ শতাংশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা। আর ১৬ শতাংশ প্রবাসী আয় আসছে সেখান থেকে। অন্যদিকে মোট পণ্য আমদানির পৌনে ৪ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

রপ্তানিতে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র

পণ্য রপ্তানিতে অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। মাঝে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে জার্মানি বাংলাদেশি পণ্যের শীর্ষ গন্তব্য হলেও সেটি বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির ২০ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। যদিও মোট পণ্য রপ্তানির ৪৪ দশমিক ৬০ শতাংশের গন্তব্য ইইউ। এই বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য। তারপর জার্মানিতে ৭৫৯ কোটি ডলার, যুক্তরাজ্যে ৪৮৩ কোটি ডলার, ফ্রান্সে ২৭১ কোটি ডলার এবং স্পেনে ৩১৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই চার দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল সর্বোচ্চ, ৪৯ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত অর্থবছর ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির মধ্যে তৈরি পোশাকই ছিল ৮৬ শতাংশ, যা পরিমাণে ৯০১ কোটি ডলার। এ ছাড়া ৩১ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের ২১ শতাংশ এবং হোম টেক্সটাইলের ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।

বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানি ৮ শতাংশ কমেছে। তারপরও দেশটিতে সর্বোচ্চ ৭৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকই ছিল ৬৯৫ কোটি ডলার, যা কিনা বাংলাদেশে মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ১৮ শতাংশের কাছাকাছি।

এক দশকের বেশি সময় ধরে অপ্রচলিত বা নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নগদ সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। তারপরও মোট পোশাক রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য ও কানাডার বাইরে অন্যান্য দেশ থেকে রপ্তানি ১৫ শতাংশের ঘরে। গত অর্থবছর নতুন দেশগুলোতে ৬৩৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অবশ্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এই পণ্যের রপ্তানি তার চেয়ে ২৬৪ কোটি ডলার বেশি।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গত শুক্রবার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাজার। ইইউ আমাদের অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপির অধীনে অস্ত্র ছাড়া অন্য যেকোনো পণ্য শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। সে কারণেই আমাদের প্রায় অর্ধেক তৈরি পোশাক রপ্তানির গন্তব্য বর্তমানে ইইউ। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জিএসপি সুবিধা না দিলেও দেশটিতে ২১ শতাংশ পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। এটিকে আমরা আরও বাড়ানোর চেষ্টাও করছি।’

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে দেশটি থেকে ক্রয়াদেশ সরাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা। আবার চীনা তুলা ব্যবহার করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি কমছে ভিয়েতনামের। এই দুই দেশের ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এমন তথ্য দিয়ে ফারুক হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদেরা সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। সেটি তাঁদের বিষয়। আমরা আমাদের ব্যবসা চালিয়ে যাব। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এখনো আমাদের তৈরি পোশাকের বড় বাজার।’

আমদানিতে শীর্ষে চীন

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয় (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেড এবং সেবা খাতের আমদানিসহ মোট আমদানি ৮ হাজার ৯৩৪ কোটি ডলার)। বিপরীতে পণ্য রপ্তানি ছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার।

সেবা খাতের রপ্তানি ৮৮৮ কোটি ডলারের। যদিও গত বছর পণ্য ও সেবা রপ্তানি থেকে ৫ হাজার ২৪৭ কোটি ডলার দেশে এসেছে। আর প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারের। তার মানে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় থেকে পাওয়া ৭ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলার দিয়ে পুরো আমদানি ব্যয় মেটানো যায়নি। এখানেই ঘাটতি ছিল ১৮১ কোটি ডলারের।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.