দেশে শিশুমৃত্যু কমছে না

0
182
দেশে শিশুমৃত্যুর হার কমছে না; বরং বাড়ছে।

তিন বছর শিশুমৃত্যুর হার কমার গতি থেমে ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে মৃত্যু বাড়ছে।

স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভালো দেখা যাচ্ছে না। দেশে শিশুমৃত্যুর হার কমছে না; বরং বাড়ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিএসএস) শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিদিনই সভা-সেমিনারে বা গণমাধ্যমের কাছে স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতির কথা বলছেন। কিন্তু কেন শিশুমৃত্যুর হার কমছে না বা কমাতে পারছেন না, তার ব্যাখ্যা তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সার্কভুক্ত প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের মধ্যে পিছিয়ে আছে। এমনকি আফ্রিকার কোনো কোনো দেশ থেকেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি খারাপ।

গতকাল মঙ্গলবার বিবিএস নিজ কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ স্যাম্পেল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’ প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে তাদের মধ্যে ২৫টি শিশু মারা যায় বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২২। ২০২১ সালে পাঁচ বছর বয়সীদের মৃত্যুহার (প্রতি হাজার জীবিত জন্মে) ছিল ২৮। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩১। অর্থাৎ ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে তাদের বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগেই ৩১টি শিশু মারা যাচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সে শিশুমৃত্যুর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মারা যায় জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে অর্থাৎ নবজাতক অবস্থায়। অপরিণত জন্ম, জন্মের সময় ওজন কম হওয়া, জন্মের সময় শ্বাসকষ্ট, সংক্রমণ, জন্মগত ত্রুটি নবজাতক মৃত্যুর কারণ। এসব কারণ দূর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে শিশুমৃত্যু বেশি থেকে যাচ্ছে।

শিশুমৃত্যু পরিস্থিতি

শিশুমৃত্যুকে একাধিক বয়সসীমায় দেখা ও পর্যালোচনা করা হয়। যেমন নবজাতকের (২৮ দিনের কম বয়সী) মৃত্যু, এক বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু। তবে সাধারণভাবে শিশুমৃত্যু বলতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক তুলনার সময় এই বয়সসীমাকে ব্যবহার করা হয়। এর হিসাব হয় প্রতি হাজারে।

বিবিএস বলছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ২৯। ২০১৯ সালে তা কমে হয় ২৮। পরের দুই বছর ওই হার অপরিবর্তিত ছিল। ২০২২ সালে এসে দেখা গেল তা বেড়েছে এবং তা চার বছর আগের হারের চেয়েও বেশি।

গতকাল ‘বাংলাদেশ স্যাম্পেল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’-এর ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, বিবিএস শুধু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। তথ্য-উপাত্ত বিবিএস ব্যাখ্যা করে না। বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা কেন হচ্ছে, তা ব্যাখ্যা করবেন গবেষকেরা।

দুই মাস আগে ২০২২ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছিল জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। তাতেও বলা হয়, দেশে শিশুমৃত্যুর হার ৩১।

মায়ের দুধ না খাওয়ানোর সঙ্গে শিশুমৃত্যুর সম্পর্ক রয়েছে। অতিঝুঁকিপূর্ণ নবজাতক ও শিশুদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সব হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও মিডওয়াইফ নেই।

অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম, সভাপতি, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

বিভিন্ন দেশের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সার্কভুক্ত তিনটি দেশের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। সবচেয়ে কম শ্রীলঙ্কায়, ১১। মালদ্বীপ ও ভুটানে এই হার যথাক্রমে ২০ ও ৩০। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে। দেশটিতে ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে ৭৪টি শিশুর মৃত্যু হয় বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগেই।

সাধারণ প্রচলিত ধারণা এই যে আফ্রিকার দেশগুলোতে দারিদ্র্য বেশি এবং সেখানে শিশুমৃত্যুও বেশি। ইউনিসেফের তথ্য বলছে, আফ্রিকার অন্তত তিনটি দেশে শিশুমৃত্যু পরিস্থিতি বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। ২০২১ সালে তিউনিসিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৬। একই সময়ে মরক্কো ও আলজেরিয়ায় এই হার ছিল যথাক্রমে ১৮ ও ২১।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পৃথক দুটি কর্মসূচি মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে কাজ করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি) মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘শিশুমৃত্যু বেড়েছে এমন কোনো রেকর্ড আমাদের কাছে নেই। তবে বেড়ে থাকলে কী কারণে বেড়েছে, তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।’

শিশুমৃত্যুর কারণ

সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর কিছু কারণ উল্লেখ করা আছে। তাতে দেখা যায়, নিউমোনিয়ায় ২৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়। অপরিণত জন্ম ও জন্মের সময় কম ওজনের কারণে মৃত্যু হয় ২২ শতাংশের। জন্মের সময় শ্বাসকষ্টের কারণে মারা যায় ১৮ শতাংশ শিশু। জন্মের সময় আঘাত পাওয়া, পানিতে ডুবে, ডায়রিয়াসহ অন্য কিছু কারণে ৩৬ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়।

মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পৃথক দুটি কর্মসূচি আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে শিশুস্বাস্থ্য পরিস্থিতির আরও উন্নতি হতো। শিশু জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের দুধ খাওয়া বাঞ্ছনীয়। ছয় মাসের পর মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে পরিপূরক খাবার দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অবনতি হতে দেখা গেছে।

সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে ৬৫ শতাংশ শিশুকে জন্মের প্রথম ছয় মাসে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো হতো। ২০২২ সালে এসে সেই হার কমে ৫৫ শতাংশ হয়েছে।

৬-২৩ মাস বয়সী শিশুদের যথাযথ খাবার খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও অবনতি দেখা গেছে। ২০১৭ সালে ৩৫ শতাংশ শিশু পুষ্টিবিদদের নির্দেশিত খাবার পেত, ২০২২ সালে তা কমে হয় ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের এই বয়সী ১০টি শিশুর মধ্যে ৭টি শিশু যথাযথ খাবার পায় না।

মাতৃমৃত্যু কমছে

বাংলাদেশ স্যাম্পেল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২-এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৪ বছর। গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে নারীর বেশি।

দেশে ১০ বছর বা তার বেশি বয়সী ৬৪ শতাংশ মানুষ বিবাহিত। এই বয়সী বিবাহিত নন ২৯ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে বিধবা, বিপত্নীক, তালাকপ্রাপ্ত বা দাম্পত্যবিচ্ছিন্ন মানুষ ৭ শতাংশ।

দেশে ক্রমাগতভাবে মাতৃমৃত্যু কমছে। বিবিএস বলছে, ১ লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ২০২১ সালে ১৬৮ জন মায়ের মৃত্যু হতো। ২০২২ সালে মাতৃমৃত্যুর হার কমে হয়েছে ১৫৬। কমলেও এই হার অনেক বেশি।

জনস্বাস্থ্যবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, দেশে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম বেশি হওয়ার সঙ্গে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু বেশি হওয়ার সম্পর্ক আছে। বিবিএস বলছে, দেশে এখন ৪১ শতাংশ প্রসব হয় অস্ত্রোপচারে।

পাশাপাশি বিবিএস বলছে, দেশে ৪২ শতাংশ প্রসব এখন বাড়িতে হয়। বাড়িতে প্রসব হলে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা কম পাওয়া যায়। এতে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। হাসপাতালে ও ক্লিনিকে প্রসব হলে এই ঝুঁকি কম।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম বলেন, মায়ের দুধ না খাওয়ানোর সঙ্গে শিশুমৃত্যুর সম্পর্ক রয়েছে। অতিঝুঁকিপূর্ণ নবজাতক ও শিশুদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সব হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও মিডওয়াইফ নেই। পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে সমন্বয় বাড়াতে হবে। অর্থায়ন বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.