রাতে দেরি করে ঘুমান অনেকেই। আবার বেশি সময় ঘুমাতে পারেন না অনেকে। এতে যে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, তা আমরা অনেকে বুঝি। আবার ঘুম ভালো হলে শরীর ফুরফুরে লাগে, এটাও বুঝতে পারি। কিন্তু অল্প দেরি করে ঘুমালেও এর প্রভাব কত বেশি, তা উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কিশোর-তরুণ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যায় এবং বেশি সময় ঘুমায়, তাদের মস্তিষ্ক বেশি সচল থাকে। ঘুম ভালো হলে মস্তিষ্কও ভালো কাজ করে। বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষায় তারা ভালো নম্বরও পায়। এই গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেল রিপোর্টস জার্নালে।
তিন হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে নিয়ে এই গবেষণা করা হয়। তাতে দেখা গেছে, যারা রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছে, বেশি সময় ঘুমিয়েছে এবং ঘুমের সময় যাদের হৃদস্পন্দন (হার্টবিট) কম ছিল, তারা পড়াশোনায় সবচেয়ে ভালো করেছে। সমস্যা সমাধান আর যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার মতো পরীক্ষাগুলোতে বাকিদের পেছনে ফেলেছে তারা।
গবেষকেরা দেখেছেন, ঘুমের সামান্য পার্থক্যও মানুষের মস্তিষ্কে অনেক প্রভাব ফেলে। এই গবেষণা দলের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল নিউরোসাইকোলজির অধ্যাপক বারবারা সাহাকিয়ান। তিনি বলেন, ‘আমরা ঘুমের সময় স্মৃতি সংরক্ষণ করি। তাই ঘুম ভালো হলে স্মৃতিশক্তি ভালো থাকে, মস্তিষ্ক ভালোভাবে কাজ করতে পারে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ঘুমে সামান্য পরিবর্তন হলেও তার প্রভাব অনেক বেশি হয়।’
শিক্ষার্থীদের ঘুমের একটা সাধারণ সমস্যা আছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে সপ্তাহে ৫/৬ দিন স্কুলে যায়। স্কুলের দিন ওদের খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠতে হয়। আর ছুটির দিনে ওরা বেশি সময় ঘুমায়। এতে ঘুমের চক্র নষ্ট হতে পারে।
ভালো ঘুম হলে যে সারাদিন শরীর ফুরফুরে লাগে, তা আমরা জানি। কিন্তু গবেষকেরা একটা নতুন বিষয় জানার চেষ্টা করেছেন। কিশোর বয়সে মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ হয়। একই সময়ে কিশোরদের মধ্যে রাত জেগে থাকার প্রবণতা বাড়ে। এই সময়ে ওদের মস্তিষ্কে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে, তা জানা ছিল না গবেষকদের। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তাঁরা এই পরীক্ষা করেছেন।
এই গবেষণায় যেসব শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হয়েছিল। তারপর তাদের নানারকম মানসিক দক্ষতার পরীক্ষা নেওয়া হয়। পাশাপাশি ফিটবিটের মাধ্যমে তাদের ঘুমের হিসাব রাখা হয়। মোট তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয় ওদের। প্রথম দল সবচেয়ে দেরিতে ঘুমোতে যেত এবং সবচেয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠত। এই গ্রুপে প্রায় ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিল। তারা প্রতি রাতে গড়ে ৭ ঘণ্টা ১০ মিনিট ঘুমাত। দ্বিতীয় দলের প্রায় ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী গড়ে ৭ ঘণ্টা ২১ মিনিট ঘুমাত। আর তৃতীয় দলের ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঘুমাত সবচেয়ে তাড়াতাড়ি। এরা সবচেয়ে বেশি সময়ও ঘুমাত এবং ঘুমের সময় তাদের হৃদস্পন্দন ছিল সবচেয়ে কম। তারা গড়ে প্রায় ৭ ঘণ্টা ২৫ মিনিট ঘুমিয়েছে।

যদিও এই তিন দলের পড়াশোনার ফলাফলে তেমন কোনো বড় পার্থক্য দেখা যায়নি। তবে তৃতীয় দলটি বুদ্ধির পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে। এরপর দ্বিতীয় দল, আর সবচেয়ে খারাপ করেছে প্রথম দল। অর্থাৎ যারা সবচেয়ে দেরিতে এবং কম সময় ঘুমিয়েছে, তারা। মস্তিষ্কের স্ক্যানে দেখা গেছে, তৃতীয় দলের মস্তিষ্কের আকার সবচেয়ে বড় ছিল। ওদের মস্তিষ্কের কার্যক্রমও ছিল সবচেয়ে ভালো।
অধ্যাপক সাহাকিয়ান বলেন, ‘ঘুমের সামান্য পার্থক্য যে এত বড় প্রভাব ফেলেছে, তা দেখে আমরা অবাক হয়েছি। প্রত্যেক দলের মধ্যে ঘুমের পার্থক্য কয়েক মিনিটের। কিন্তু প্রভাবটা অনেক বেশি।’
তবে শুধু গবেষণা করেই থামেননি অধ্যাপক সাহাকিয়ান। যে কিশোরেরা ভালোভাবে ঘুমাতে চায়, তাদের তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়েছেন। বেশি রাতে মোবাইল ও কম্পিউটার ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।
ভালো ঘুম হলে যে সারাদিন শরীর ফুরফুরে লাগে, তা আমরা জানি। কিন্তু গবেষকেরা একটা নতুন বিষয় জানার চেষ্টা করেছেন। কিশোর বয়সে মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ হয়। একই সময়ে কিশোরদের মধ্যে রাত জেগে থাকার প্রবণতা বাড়ে।

শিক্ষার্থীদের ঘুমের একটা সাধারণ সমস্যা আছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে সপ্তাহে ৫/৬ দিন স্কুলে যায়। স্কুলের দিন ওদের খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠতে হয়। আর ছুটির দিনে ওরা বেশি সময় ঘুমায়। এতে ঘুমের চক্র নষ্ট হতে পারে। আবার ছুটির আগের দিন রাতে অনেকেই দেরী করে করে ঘুমায়। এতে ঘুমের সমস্যা হয়। যথেষ্ট সময় ঘুম হয় না, হলেও তা গভীর হয় না। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব স্লিপ মেডিসিন অনুসারে, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের প্রতি রাতে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক গ্যারেথ গ্যাসকেলের মতে, ‘এই গবেষণায় বয়ঃসন্ধিকালের শুরুর দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। কিশোর-কিশোরীদের ঘুম নিয়ে আরও গবেষণা দেখতে চাই, যাতে ওদের সাহায্য করা যায়।
কাজী আকাশ
সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা