দুর্বল শিক্ষার্থীদের যত্ন নেই, আগ্রহ প্রাইভেটে

0
253
  • প্রতিবেদনের আওতায় আসা বিদ্যালয় ৬৮৭২টি।
  • ৫২৭টি বিদ্যালয় দুব৴ল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে না।
  • ১৫০৭টি বিদ্যালয় দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করলেও যত্ন নেয় না।
  • শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেও ঘাটতি।
  • স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের প্রতি নজর না দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) শিক্ষাবিষয়ক তদারকি প্রতিবেদন বা একাডেমিক সুপারভিশন রিপোর্টে। কয়েক মাস পরপরই এ প্রতিবেদন তৈরি করে মাউশির অ্যাকসেস অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স (অভিগম্যতা ও মান নিশ্চিতকরণ) ইউনিট।

    মাউশি গত সেপ্টেম্বরে ৬ হাজার ৮৭২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় তদারক করে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে দেখা যায়, ২২ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৫০৭টি) স্বল্প কৃতিধারীদের চিহ্নিত করলেও কোনো পদক্ষেপ নেয় না। আর প্রায় ৮ শতাংশ বিদ্যালয় (৫২৭টি) স্বল্প কৃতিধারীদের চিহ্নিতই করে না।

    শিক্ষকদের বড় অংশের শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট পড়ানোর দিকে নজর বেশি থাকে।
    অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

    দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৮ হাজার ৮৭৪। গত মে মাসেও একই প্রতিবেদনে একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছিল। এর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তৈরি করা প্রতিবেদনে হারটি ছিল ৪১ শতাংশ। মাউশি ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে তদারক করে। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সারা দেশের প্রতি তিনটি স্কুলের একটিতে স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের আলাদা যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। অভিযোগ রয়েছে, শুধু প্রতিবেদনই তৈরি করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

    মাউশি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০–এর এই তদারকি প্রতিবেদন করে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রকল্পের (সেসিপ) অধীনে। প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়বস্তু ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ঘাটতি আছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেসিপের যুগ্ম কর্মসূচি পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব)

    বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পিএইচডি করার ব্যবস্থা হচ্ছে

    অধ্যাপক সামসুন নাহারের কথায়ও। তিনি বলেন, প্রতিবেদন পাওয়ার পর তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তাঁরা মাউশির আঞ্চলিক পরিচালকদের চিঠি দেন। তবে অনেক সময় সমন্বয়হীনতার কারণে তদারকির কাজে অসুবিধা হয়। তিনি বলেন, বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে প্রকল্পের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত একাডেমিক সুপারভাইজাররা রাজস্ব খাতের নয়। ফলে তাঁদের সঙ্গে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের অনেক সময় সমন্বয়হীনতা হয়।

    বিষয়টি নিয়ে মাউশির বক্তব্য জানতে গতকাল সোমবার সংস্থাটির মহাপরিচালক নেহাল আহমেদের দপ্তরে গেলে তিনি বলেন, আগে খুব একটা ব্যবস্থা নেওয়া হতো না। এখন নিয়মিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি শিক্ষকসংকটের বিষয়টিও তুলে ধরেন।

    স্বল্প কৃতিধারী কারা

    শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা কোনো বিষয়ে বা বিষয়গুলোতে ৩০ শতাংশের কম নম্বর পেয়েছে এবং যারা ধারাবাহিক মূল্যায়নে (সিএ) ভালো করেনি, সেসব শিক্ষার্থীকে স্বল্প কৃতিধারী হিসেবে গণ্য করা হয়। মাউশির নিয়মানুযায়ী, এ ধরনের শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করবেন বিষয় ও শ্রেণিশিক্ষক। এ তালিকা করার সময় দুর্বল শিক্ষার্থীর নাম, রোল নম্বর, দুর্বলতার কারণ, সহায়তার ধরন ও সহায়তা পাওয়ার ফলাফল ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে।

    মাউশির সর্বশেষ প্রতিবেদনে স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মাউশির আঞ্চলিক পরিচালক, জেলা ও উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।

    মাউশির নিয়মানুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে পরিবীক্ষণ ও তদারক করা হয়। এর মধ্যে এ শ্রেণির (ভালো) বিদ্যালয়গুলোতে প্রতি তিন মাসে একবার, বি শ্রেণির বিদ্যালয়গুলোকে প্রতি দুই মাসে একবার, সি শ্রেণির বিদ্যালয়গুলোতে দেড় মাসে একবার এবং ডি এবং ই শ্রেণির (দুর্বল) বিদ্যালয়গুলোতে প্রতি মাসে একবার পরিবীক্ষণ ও তদারকির কথা। তদারকির কাজটি করবেন উপজেলা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং অন্য কর্মকর্তারা। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিবিড়ভাবে তদারকি হয় না।

    রাজধানীর রমনা থানার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, তাঁদের অধীনে মোট ৩৯টি বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের বেশির ভাগেই দুব৴ল শিক্ষার্থীদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়। তবে কিছু বিদ্যালয়ে তা নেওয়া হয় না।

    শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, যে শিক্ষার্থী যে বিষয়ে দুর্বল, সেই শিক্ষার্থীকে আলাদা করে সে বিষয়ে পড়াতে হবে। সেটা করতে হবে নিয়মিত ক্লাসের বাইরে।

    ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের সদ্য সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, এ কাজ করা খুব কঠিন নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। অনেক বিদ্যালয়ে বিদ্যমান জনবলকাঠামো অনুযায়ীই শিক্ষক নেই। সে ক্ষেত্রে বাস্তবে এ কাজ করা বেশ কঠিন। তিনি বলেন, ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের কথাই ধরা যাক। এখানে একেকটি ক্লাসে ৭০ থেকে ৮০ জনের মতো শিক্ষার্থী আছে। এখন দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করলে সেই পরিমাণ শিক্ষক তো নেই।

    মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন ছুটি চলছে। তবে গতকাল দপ্তরে পাওয়া গেল রাজধানীর সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এ কে এম ওবাইদুল্লাহকে। স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আলাদা পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যে সহায়তা দেওয়া দরকার, তা দেওয়া সম্ভব হয় না। শিক্ষকেরা নির্ধারিত সময়ের পর থাকতে চান না। এ বিষয়ে সরকারি পর্যায় থেকে লিখিত নির্দেশনা থাকলে ভালো হতো।

    ক্লাসে নয়, কোচিংয়ে জোর

    স্কুলে স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের বাড়তি যত্নের জন্য সময় না থাকলেও কোচিং ও প্রাইভেটের জন্য সময় ঠিকই বের করে নেন শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীদের কোচিং-প্রাইভেট পড়ানোয় এখন আর কোনো রাখঢাক নেই। বরং শ্রেণিকক্ষের এক প্রকার বিকল্প হয়ে উঠেছে কোচিং-প্রাইভেট। আর এ জন্য অভিভাবকদের খরচ বাড়ছে।

    জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর গত জানুয়ারিতে প্রকাশ করা এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে। প্রাইভেট পড়ানোর খরচের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে পরিবারের প্রাইভেট পড়ানোর খরচ ২০০০ সালে ছিল ২৮ শতাংশ, যেটা ২০১০ সালে বেড়ে হয়েছে ৫৪ শতাংশ। এ সময় শহরাঞ্চলে হারটি ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭ শতাংশ। সাম্প্রতিক চিত্র প্রতিবেদনটিতে ছিল না।

    অবশ্য অনেকে মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির সম্প্রতি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না। কোচিং-প্রাইভেট ছাড়া উপায় নেই। অভিভাবকেরা শিক্ষকদের কাছে এক প্রকার ‘জিম্মি’ হয়ে পড়ছেন।

    বেশির ভাগ দুর্বল

    স্কুলে বাড়তি যত্ন না থাকার ফল হচ্ছে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে যথাযতভাবে শিখতে পারছে না। সম্প্রতির মাউশির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার একটি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে দুর্বল। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের অবস্থা খারাপ বা গড়পড়তা।

    কোচিং ও প্রাইভেটের পেছনে সচ্ছল পরিবারগুলো বাড়তি ব্যয় করতে পারে। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো পারে না। এতে ভয়াবহ বৈষম্য তৈরি হয়। কোনো কোনো পরিবার সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে তখন কোচিং-প্রাইভেটে বাধ্য হয়।

    নাম প্রকাশে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিকের একটি শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এক ছাত্রীর বাবা জানান, তাঁর এক সন্তান এখন এ বিদ্যালয়ে পড়ে। আরেক সন্তান সম্প্রতি এ প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। তাঁর কোচিং ও বাসায় প্রাইভেট শিক্ষকের পেছনে মাসে ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হতো।

    শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১২ সালে মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং–বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা করেছিল। তবে তা কেউ মানেনি।

    আরও ঘাটতি

    মাউশির ওই প্রতিবেদনে বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, পরিবেশগত সমস্যার পাশাপাশি শিক্ষার আরও নানা ঘাটতির চিত্র উঠে এসেছে। যেমন জরিপের আওতায় আসা বিদ্যালয়গুলোর ৮৬ হাজার ৪৭১ জন শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ৫২ শতাংশ সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাননি।

    এ ছাড়া ৬ হাজার ৮৭২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ১ হাজার ৮৫৬টিতে বিজ্ঞানাগার নেই, ১ হাজার ১৭০টিতে গ্রন্থাগার নেই, ৩ হাজার ৮৪৪টিতে তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বা কম্পিউটার ল্যাব নেই এবং ৩ হাজার ৫১টিতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নেই। ২০৭টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শৌচাগার (টয়লেট) ব্যবহারযোগ্য নয়। নয়টিতে শৌচাগারই নেই।

    সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগ বেসরকারি। সেখানে মানসম্মত শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। ফলে এই শিক্ষকদের দিয়ে দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, আরেকটি সমস্যা হলো, শিক্ষকদের বড় অংশের শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট পড়ানোর দিকে নজর বেশি থাকে।

    মাধ্যমিকে তদারকি ব্যবস্থা দুর্বল বলে উল্লেখ করে অধ্যাপক হাফিজুর রহমান আরও বলেন, বিদ্যালয়গুলোতে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি তদারকি জোরদার করা দরকার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.