পরপর ২ বলে ধোঁকা খেয়ে গেলেন। দুবারই টেস্টে প্রথম ৫ উইকেট পাওয়ার আনন্দ উদ্যাপন করে দেখেন, ব্যাটসম্যান তো আউটই হননি!
আফগানিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসের ৩৩তম ওভার। বোলিং করছিলেন ততক্ষণে ৪ উইকেট পেয়ে যাওয়া তাসকিন আহমেদ। ওভারের প্রথম বলে আফগান ব্যাটসম্যান জহির খানের হাতে চার খাওয়ার পরের বলেই চেনা দৃশ্য—শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে দুই হাত মেলে উড়ছেন তাসকিন। জহিরের বিরুদ্ধে কট বিহাইন্ডের আবেদনে সাড়া দিয়ে দিয়েছেন আম্পায়ার। টেস্টে প্রথম ৫ উইকেট পাওয়ার আনন্দে তো ওড়াই যায়।
কিন্তু জহির রিভিউ নিলে দেখা গেল, বল তাঁর ব্যাটে তো লাগেইনি, গেছেও অনেকটা দূর দিয়ে। পরের বলে আরও একবার ভাগ্য হাসল তাসকিনের দিকে চেয়ে এবং চকিতে উধাও সেই হাসিও। তাসকিনের ফুল টস ডেলিভারিতে বোল্ড জহির। তাসকিন আবার আনন্দে উদ্বাহু। কিন্তু ওদিকে যে কোমর উচ্চতায় ছোড়া বলের জন্য ‘নো’ ডেকে বসেছেন আম্পায়ার! তাসকিনের আরও একটি ‘৫ উইকেট’–এর আনন্দ তাতে বাতিল হয়ে গেল।
মানুষ ঠেকে শেখে, তাসকিনও শিখেছেন। কাল দু–দুবার ও রকম ধোঁকা খেয়ে একটা সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছেন বাংলাদেশ দলের এই পেসার। বিকেলে হোটেল থেকে বাসায় ফেরার পথে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে তাসকিন বললেন সেই সিদ্ধান্তের কথাই, ‘এ রকম অভিজ্ঞতা মনে হয় না খুব বেশি বোলারের আছে। দুবার ৫ উইকেট পেয়েও পেলাম না (হাসি)। শুধু শুধু উদ্যাপন করলাম। এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এরপর যদি টেস্টে এ রকম ৫ উইকেট পাই, আগে সব দেখেশুনে নিশ্চিত হয়ে তারপর উদ্যাপন করব।’
চোটের কারণে আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে তাসকিনের খেলার কথা ছিল না। তাঁকে দলে রাখার মূল উদ্দেশ্য ছিল ঠিকঠাক পরিচর্যা করা। কিন্তু এরপর যখন ম্যাচের আগেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন, তাসকিন অস্থির হয়ে উঠলেন খেলার জন্য। টেস্ট শুরুর এক দিন আগে অন্য এক প্রসঙ্গে কথোপকথনে বলেছিলেন, ‘যদি ঠিক হয়ে যাই, আমার ইচ্ছা থাকবে খেলার। সুস্থ থাকলে আমি সব ম্যাচ খেলতে চাই। কোনো খেলা মিস দিতে চাই না।’
ওদিকে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের জন্য মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সবুজ গালিচা বিছিয়ে প্রস্তুত কিউরেটর গামিনি ডি সিলভা। টেস্টের আগের দিনের বৃষ্টিতে অনুশীলন বাতিল হলেও বিকেলে বিসিবি সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে স্টেডিয়ামে আসেন হাথুরুসিংহে। উইকেটের এ মাথা থেকে ও মাথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যেন নিশ্চিত হতে চাইলেন, তাঁর পেসারদের হাতে থাকা বিষ আফগান ব্যাটসম্যানদের কতটা নীল করে তুলতে পারবে এখানে।
এখন তো বোঝাই যাচ্ছে, উইকেট থেকে কী বার্তা পেয়েছিলেন কোচ। তাসকিনও যেহেতু খেলার জন্য প্রস্তুত এবং বলতে গেলে তেঁতেই ছিলেন, তিন পেসারের বোলিং আক্রমণে তাঁকেও যুক্ত করে নিলেন হাথুরুসিংহে।
ফল তো চোখের সামনে। প্রথম ইনিংসে ইবাদত হোসেনের পরিকল্পিত বোলিংয়ে ৪ উইকেট, ২ উইকেট নেন আরেক পেসার শরীফুল ইসলামও। দ্বিতীয় ইনিংসে আগুন ঝরিয়ে ৪ উইকেট নিলেন তাসকিন, শরীফুলের ৩টি ও ইবাদতের সংগ্রহ ১ উইকেট। সব মিলিয়ে এক টেস্টে পেসারদেরই শিকার ১৪ উইকেট, এক টেস্টে বাংলাদেশের পেসারদের এত উইকেট এবারই প্রথম।
তবে সবুজ উইকেট মানেই এই নয় যে পেসাররা বল করলেন আর উইকেট পেয়ে গেলেন। প্রথম ইনিংসের পর ইবাদত যেমন বলেছিলেন, কীভাবে তিনি ব্যাটসম্যানদের মানসিকতা নিয়ে খেলেছেন, ‘সামনে বল ফেলে আমি ব্যাটসম্যানদের মানসিকতা একভাবে তৈরি করেছি, এরপর হঠাৎ বাউন্সার করেছি। ব্যাটসম্যানের মানসিকতায় প্রভাব ফেলে বোলিং করে আস্তে আস্তে উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
তাসকিন পরে বুঝেছেন, প্রথম ইনিংসে তাঁর ভুলটা ছিল এই জায়গাতেই, ‘সবুজ উইকেট দেখে হয়তো আমি অতিরিক্ত এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলাম। সে জন্যই লাইন-লেংথ ঠিক হচ্ছিল না। পরে বুঝেছি, ভালো জায়গায় বল না ফেললে সবুজ উইকেটেও উইকেট পাওয়া যাবে না।’
তাসকিনের দুই বছর পর অভিষেক হলেও ইবাদত টেস্ট খেলেছেন বেশি (২০টি)। লাল বলে এরই মধ্যে একবার পেয়ে গেছেন ৫ উইকেটও। গত বছরের জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ইবাদতের ৬ উইকেটই বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল স্মরণীয় জয়।
চোট-আঘাতের কারণে মাঝেমধ্যেই থামতে হয়েছে বলে তাসকিনের টেস্ট এখন পর্যন্ত ১৩টি। এই ১৩ টেস্টে কাল তৃতীয়বারের মতো ৪ উইকেট পেলেন, ইনিংসে ৫ উইকেটের স্বাদ এখনো পাওয়া হয়নি তাঁর। এ নিয়ে হতাশা থাকাটাই স্বাভাবিক। তাসকিনেরও আছে, ‘৫ উইকেট পাইনি বলে খুব যে মন খারাপ, তা নয়। তবে বোঝেনই তো, টেস্টে ৫ উইকেট পাওয়াটা তো একটা ব্যাপার…।’
ঘরের মাঠের সবুজ উইকেটে সুযোগটা হাতছাড়া হওয়াতেই তাসকিনের অতৃপ্তিটা বেশি। তবে কে জানে, এই অতৃপ্তিই হয়তো ভবিষ্যতে আরও আগুন ঢালবে তাঁর বোলিংয়ে।