দুই সাংবাদিকের বিরোধ থেকে সূত্রপাত, এরপর নবীগঞ্জ শহরে সংঘর্ষ-আগুন, ঝরল প্রাণ

0
49
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলা সদরের দুই গ্রামবাসীর মধ্যে দুই ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের পর শহরের প্রধান সড়কজুড়ে ধ্বংসের স্তূপ। আজ মঙ্গলবার সকালে শহরের মধ্য বাজার থেকে তোলা

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলা সদরের মানুষের কাছে আজ সকালটা ছিল বিভীষিকাময়। শহরের প্রধান সড়কজুড়ে ছিল ধ্বংসের স্তূপ। দেখে মনে হয়, শহরটির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বড় ধরনের এক ঝড়। উপজেলা সদরের দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনার পর এমন দৃশ্য দেখা গেছে শহরটিতে।

সংঘাতটির সূচনা হয় স্থানীয় দুজন গণমাধ্যমকর্মীর বিরোধ থেকে। পরে তা এলাকাভিত্তিক দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জড়ানো এ সংঘাতে প্রাণ হারান একজন, আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। সংঘর্ষকালে শহরে বেশ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কিছু দিন ধরে দৈনিক আলোকিত সকাল পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি আশায়েদ আলী ও হবিগঞ্জের সময় পত্রিকার প্রকাশক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সেলিম তালুকদারের মধ্যে পেশাগত ও প্রেসক্লাব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। এ নিয়ে উভয়ই ফেসবুকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছিলেন। আশায়েদ আলীকে ৪ জুলাই নবীগঞ্জ উপজেলা সদরের মধ্যবাজারে একটি বিপণিবিতানের সামনে পেয়ে তিমিরপুর গ্রামের বাসিন্দা ও গণমাধ্যমকর্মী সেলিম তালুকদার এবং তাঁর লোকজন মারধর করেন বলে অভিযোগ। এ সময় বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীরা হামলাকারীদের মধ্য থেকে দুই তরুণকে আটক করে পুলিশে দেন। ওই দুই তরুণের বাড়ি তিমিরপুর গ্রামে।

এ ঘটনায় তিমিরপুর গ্রামের লোকজন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তাঁদের অভিযোগ, উপজেলার আনমুন গ্রামের লোকজন তাঁদের দুজনকে ধরে পুলিশে দিয়েছেন। এ নিয়ে দু-তিন দিন ধরে ওই দুই গ্রামের লোকজন মারামারি করেন কয়েক দফা। একপর্যায় এ মারামারি এলাকার মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ও অমৎস্যজীবী সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আনমুন গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের। এ সূত্র ধরে সর্বশেষ গতকাল সোমবার দুপুরে ঘোষণা দিয়ে আনমুন ও তিমিরপুর গ্রামের লোকজন লাঠিসোঁটা, বল্লমসহ দেশি অস্ত্র নিয়ে নিয়ে জড়ো হতে থাকেন নিজ নিজ এলাকায়। তিমিরপুর গ্রামের পক্ষ নেয় পার্শ্ববর্তী পূর্ব তিমিরপুর, পশ্চিম তিমিরপুর, আলিপুর, চড়গাঁও এবং আনমুন গ্রামের পক্ষ নেয় রাজনগর, গন্ধা, রাজাবাদসহ কয়েকটি গ্রাম।

সংঘাতটির সূচনা হয় স্থানীয় দুজন গণমাধ্যমকর্মীর বিরোধ থেকে। পরে তা এলাকাভিত্তিক দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আজ মঙ্গলবার সকালে শহরের মধ্য বাজার থেকে তোলা
সংঘাতটির সূচনা হয় স্থানীয় দুজন গণমাধ্যমকর্মীর বিরোধ থেকে। পরে তা এলাকাভিত্তিক দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আজ মঙ্গলবার সকালে শহরের মধ্য বাজার থেকে তোলা

বিকেলে উপজেলা সদরে মুখোমুখি হয় দুই পক্ষ। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। শতাধিক মানুষ আহত হন। তিমিরপুর গ্রামের ফারুক তালুকদার নিহত হন সংঘর্ষে। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দোকানপাট, হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ নানা প্রতিষ্ঠান। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রাতেই জারি হয় ১৪৪ ধারা, যা আজ মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানিয়েছেন নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন।

‘আমি কোনো পক্ষ না, তবু আমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে’

আজ সকালে নবীগঞ্জ শহরে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে থমথমে পরিবেশ। সকাল ১০টার দিকে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে কয়েকজন ব্যবসায়ী সড়ক থেকে ভাঙা দোকানের ধ্বংসাবশেষ সরাচ্ছিলেন।

এ সময় নবীগঞ্জ হাইস্কুলের সামনে মুদি ব্যবসায়ী সিরাজ আলী বলেন, ‘আমি কোনো পক্ষের লোক না। তবু আমার ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে একটি পক্ষ। এখন আমি দিশাহারা।’

নবীগঞ্জ নতুন বাজারের ব্যবসায়ী নীরব পাল বলেন, ‘এ সংঘর্ষে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসে গেছেন। ক্ষতি পূরণ করে ব্যবসা দাঁড় করানো কঠিন হবে। আমরা এ ধরনের সংঘাত চাই না। কষ্ট লাগে, সমাজের দায়িত্বশীল কেউ এর সমাধানে এগিয়ে আসছেন না। এখন এমন অবস্থা যে কেউ ভয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছে না।’

তিমিরপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সবাই নিহত ফারুক তালুকদারের লাশের অপেক্ষায়। ময়নাতদন্ত শেষে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল থেকে কখন লাশ আসবে, সেই অপেক্ষায় স্বজনেরা।

তিমিরপুর গ্রামের সাবেক পৌর কাউন্সিলর আলাউদ্দিন বলেন, ‘এ সংঘর্ষের কারণে আমাদের গ্রামের একজন প্রাণ হারিয়েছেন। এমন মৃত্যু কারও কাম্য নয়। সবাই একটু সংযত থাকলে হয়তো এ সংঘাত এড়ানো যেত।’ তিনি জানান, সংঘাত এখন দুই সম্প্রদায়ে রূপ নিয়েছে—একটি মৎস্যজীবী (আনমুন) সম্প্রদায়, অন্যটি অমৎস্যজীবী (তিমিরপুর)। এ বিভক্তি সমাজে গভীর সংকট তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি।

নবীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র ও নবীগঞ্জ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ছাবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, সংঘর্ষে নবীগঞ্জ শহরের দেড় শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়। হাসপাতাল-ক্লিনিকও রক্ষা পায়নি। কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রশাসন সংঘর্ষের প্রায় এক ঘণ্টা পর ১৪৪ ধারা জারি করে। আগে করলে হয়তো এত বড় ক্ষতি হতো না।

নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে এখনো কেউ অভিযোগ করেননি। তবে আমরা আমাদের মতো করে আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি। এ ঘটনায় সাতজনকে আটক করা হয়েছে।’

নবীগঞ্জের ইউএনও রুহুল আমিন বলেন, ‘উভয় পক্ষ আমাদের কাছ থেকে সময় নিয়েছিল মীমাংসার জন্য। কিন্তু আকস্মিকভাবে হাজারো মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরিবেশ পর্যবেক্ষণ না করে তৎক্ষণাৎ ১৪৪ ধারা জারি করা যায় না। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত। সেনাবাহিনী ও পুলিশ মাঠে আছে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.