হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসে দুই ধরনের লকার রুম আছে। একটি ট্রানজিট গোডাউন রেজিস্টার (টিজিআর), আরেকটি ভ্যালুয়েবল গোডাউন রেজিস্টার (ভিজিআর)। চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার আগে জব্দ স্বর্ণালংকার, বিদেশি মুদ্রাসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত টিজিআরে রাখা হয়। সেই কক্ষের স্টিলের ভল্ট ভেঙে দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটেছে। বিমানবন্দরের মতো প্রথম শ্রেণির কেপিআইভুক্ত এবং স্পর্শকাতর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ভল্ট ভেঙে ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি স্বর্ণ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় কাস্টমসের চার কর্মকর্তাসহ ৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
ওই গুদামের ওপরের অংশে বাতাস বের হওয়ার জায়গা রয়েছে; পাশেই আছে বাথরুম। এর পাশে সুড়ঙ্গের মতো কাটা অংশ। দেখে যে কারও মনে হতে পারে, সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে চোর চক্র লকার রুমে ঢুকেছিল।
মামলার তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রাথমিক ধারণা, দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নিতেই সুড়ঙ্গ তৈরির নাটক করা হয়েছে। অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে স্বর্ণ সরানো হয়েছে। যারা লকার রুমে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন, তাদের মধ্যে তিনজনকে সন্দেহের কেন্দ্রে রেখে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। তারা হলেন– সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম শাহেদ, শহিদুল ইসলাম ও সিপাহি নিয়ামত হাওলাদার। সাধারণত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তারা ভল্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন। একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
স্বর্ণ চুরির ঘটনায় গত রোববার মধ্যরাতে ঢাকা কাস্টম হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেছেন। পুলিশের একাধিক টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। চারজন সিপাহিকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তারা হলেন– নিয়ামত হাওলাদার, আফজাল হোসেন, রেজাউল করিম ও মোজাম্মেল হক। গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে মূল সন্দেহভাজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম শাহেদ ও শহিদুল ইসলামকে। যে কোনো সময় হেফাজতে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও চার সিপাহিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পেরেছে, লকার রুমে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। এ ছাড়া প্রবেশপথে একটি ক্যামেরা থাকলেও তা নষ্ট ছিল। কেন সামনের ক্যামেরা নষ্ট ছিল– এ রহস্যের জট খোলার চেষ্টা চলছে। লকার রুম থেকে কিছু দূরে আরও কয়েকটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। ওইসব ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে দায়ীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। লকার রুমের ভেতরে ও গেটের ফুটেজ না পাওয়ায় চোর চক্র শনাক্ত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
স্বর্ণ চুরির এ ঘটনা কাস্টম হাউসের নজরে আসে গত শনিবার। তবে বিষয়টি পরদিন জানাজানি হয়। বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসের নিজস্ব গুদামে দিনভর ইনভেন্টরি শেষে ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি সোনা চুরি বা বেহাত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এজাহারে বলা হয়েছে। তবে তাদের সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়নি। পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য অতিরিক্ত কমিশনার কাজী ফরিদ উদ্দিনকে প্রধান করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করে কাস্টম হাউস।
মামলার এজাহারে বলা হয়, শনিবার সকাল ৯টার দিকে গুদাম কর্মকর্তা মাসুদ রানা মোবাইল ফোনে যুগ্ম কমিশনারকে জানান, বিমানবন্দরের ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার কাছে টিজিআর-১ এর অভ্যন্তরে মূল্যবান পণ্যসামগ্রী রাখার একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙা। মাসুদ রানা যুগ্ম কমিশনারকে আরও জানান, প্রতিদিনের মতো জব্দ পণ্য গুদামে রেখে তিনিসহ চারজন কর্মকর্তা আগের দিন রাত সোয়া ১২টার দিকে চাবি নিয়ে কাস্টমস এলাকা ত্যাগ করেন। এমন সংবাদ পেয়ে কাস্টমসের কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা গুদামের একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙা দেখেন। গুদামের পূর্ব পাশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের বাতাস যে অংশ দিয়ে বের হয়, সেখানকার টিনের কিছু অংশ কাটা দেখতে পান। পরে তারা গুদামের দায়িত্বে থাকা চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সিপাহিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। এর পর সেখান থেকে কোনো মূল্যবান বস্তু চুরি হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে গুদামের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনা দেন কমিশনার। গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা হলেন– সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুদ রানা, সাইদুল ইসলাম শাহেদ, শহিদুল ইসলাম, আকরাম হোসেন এবং সিপাহি রেজাউল করিম, মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন ও নিয়ামত হাওলাদার।
জানা যায়, উধাও হওয়া স্বর্ণ ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জব্দ করা হয়। বিমানবন্দরের ভেতরের সব জায়গায় সিসিটিভির নজরদারি থাকে। বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কাজ করেন। এত নিরাপত্তার মধ্যে গুদাম থেকে স্বর্ণ চুরি হওয়া ও কাস্টম হাউসের গুদামে সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তদন্তে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, গত ১০ আগস্ট লকার রুমের নিরাপত্তার দায়িত্ব সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম শাহেদ ও শহিদুল ইসলামের কাছ থেকে বুঝে নেন মাসুদ রানা ও আকরাম হোসেন। ধারণা করা হচ্ছে, স্বর্ণ চুরির ঘটনা ঘটেছে শাহেদ ও শহিদুলের দায়িত্ব পালনকালে। তারাই এখন পর্যন্ত সন্দেহের মূলে। শাহেদ ও শহিদুলের কাছ থেকে লকার রুমের নিরাপত্তার দায়িত্ব অন্য কর্মকর্তাদের কাছে যাওয়ার পরই ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয় ধরা পড়তে শুরু করে। তখন কাস্টমের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে শুরু করেন। ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার লকার রুমের পুরোনো ব্যবস্থাপনার বদলে আধুনিকায়নের কাজে হাত দেন। গুদামের অটোমেশনের কাজ শুরু করতে থাকেন। পুরোনো লকার বদলে আধুনিক ও অধিক নিরাপত্তা-সংবলিত লকারের ব্যবস্থা করেন। ৭-৮ দিন আগে থেকে গুদামে থাকা স্বর্ণ গণনার কাজও শুরু হয়। এর পরই চুরির বিষয়টি ধরা পড়ে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ধারণা, অল্প অল্প করে অনেক দিন ধরে লকার রুম থেকে নানা কৌশলে স্বর্ণ গায়েব করা হয়েছে। লকার রুমের অটোমেশন করার কার্যক্রম শুরু হলে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভল্ট ও সুড়ঙ্গ তৈরির নাটক করা হয়েছে। একটি সূত্র এও বলছে, গুদামের নিরাপত্তায় জড়িত একজন কর্মকর্তা নিজের চুরির বিষয়টি ধরা পড়ার ভয়ে বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে স্বর্ণ কিনে লকার রুমে ঢোকানোর ছক কষছিলেন। এ ছাড়া চুরির ঘটনা শনাক্ত হওয়ার আগে তাঁতীবাজারের দুই স্বর্ণ কারবারি কেন একসঙ্গে বিমানবন্দরে গেলেন, তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, লকার রুমের ভেতরে সিসি ক্যামেরা নেই। ফটকের ক্যামেরা নষ্ট। তাদের ধারণা, অল্প অল্প করে স্বর্ণ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরে সুড়ঙ্গ তৈরি ও লকার রুম ভেঙে দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্লু পাওয়া গেছে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, গুদামে অনেক লকার থাকলেও স্বর্ণ চুরি হয়েছে একটি লকার থেকে। অন্য লকারে চোরের হাত পড়লে আরও বড় ক্ষতি হতো। চুরি হওয়া স্বর্ণের মূল্য ৪৫ কোটি টাকা। তবে পরিমাণ আরও বেশি কিনা, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভেতরের কেউ সরাসরি জড়িত না থাকলে বাইরের কারও পক্ষে লকার রুমে হানা দেওয়া অসম্ভব।