ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান বন্ধে তিনটি শর্ত দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। শর্তগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে, ইউক্রেনকে পুরো দনবাস অঞ্চল রাশিয়ার হাতে তুলে দিতে হবে। এ ছাড়া পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না ইউক্রেন। পাশাপাশি যুদ্ধপরবর্তী ইউক্রেনে পশ্চিমা সেনাদের মোতায়েন করা যাবে না। ক্রেমলিনের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে জানাশোনা আছে, এমন তিনটি সূত্র রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছে। আজ শুক্রবার এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
১৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন পুতিন। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সমঝোতা কেমন হতে পারে, তা নিয়ে বৈঠকে আলাপ করেছিলেন দুই নেতা। বৈঠক শেষে পুতিন বলেছিলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর ওই বৈঠক ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর পথ খুলে দেবে বলে আশা করছেন তিনি। তবে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছিল, সে বিষয়ে তাঁদের কেউই সুস্পষ্টভাবে কিছু জানাননি।
ওই বৈঠকে পুতিন কী প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে রুশ সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুনে ইউক্রেনের ভূখণ্ড নিয়ে পুতিন যে দাবি করেছিলেন, তাতে এখন কিছুটা ছাড় দিয়েছেন। তখন রুশ প্রেসিডেন্টের দাবি ছিল, ইউক্রেনের চার প্রদেশের পুরোটাই রাশিয়ার হাতে তুলে দিতে হবে। এর মধ্যে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রদেশ ছিল। এই দুই প্রদেশ নিয়ে দনবাস গঠিত। বাকি দুটি প্রদেশ হলো দক্ষিণ ইউক্রেনের খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া। তখন এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল কিয়েভ।
তবে বর্তমানে পুতিন চান, শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে দনবাসে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলো রাশিয়ার হাতে তুলে দিতে হবে ইউক্রেনকে। এর বিনিময়ে খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ায় সম্মুখসারি বরাবর যুদ্ধ বন্ধ করবে রুশ বাহিনী। এ ছাড়া ইউক্রেনের খারকিভ, সুমি ও নিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলে নিজেদের দখলে থাকা ছোট ছোট এলাকাগুলো ছেড়ে দেবে মস্কো। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দনবাসের ৮৮ শতাংশ এলাকা এবং জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের ৭৩ শতাংশ এলাকা রাশিয়ার দখলে রয়েছে।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভূখণ্ড হাতবদলে শর্তের পাশাপাশি পুতিন চান, শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আশা ত্যাগ করতে হবে। এ ছাড়া ন্যাটো যেন তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পূর্বদিকে আর সম্প্রসারণ না করে। এ দুই দাবিই যুদ্ধ শুরুর বহু আগে থেকে করে আসছিলেন পুতিন। রুশ প্রেসিডেন্ট আরও চান, ইউক্রেন বাহিনীর ওপর যেন সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় এবং যুদ্ধ শেষে দেশটিতে শান্তিরক্ষী বাহিনীর অংশ হিসেবে যেন কোনো পশ্চিমা সেনা মোতায়েন না করা হয়।
‘কিয়েভ ছাড় না দিলে যুদ্ধ চলবে’
সূত্র বলছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর আলাস্কা বৈঠকের মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় সুযোগ এসেছে। কারণ, পুতিন শান্তির জন্য প্রস্তুত আছেন। ছাড় দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। এই বার্তা ট্রাম্পের কাছেও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তবে কিয়েভ শেষ পর্যন্ত দনবাস অঞ্চল ছেড়ে দেবে কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই মস্কোর। আর কিয়েভ এই ছাড় না দিলে রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা অঞ্চলগুলোর স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্র দেবে কি না, সে বিষয়টিও এখনো পরিষ্কার নয়।
পুতিনের এসব শর্তের বিষয়ে তাৎক্ষিণভাবে কোনো মন্তব্য করেনি ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট বরাবরই বলে এসেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইউক্রেনের কোনো ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হবে না। গত বৃহস্পতিবার কিয়েভে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘পূর্বাঞ্চল থেকে যদি সাধারণভাবে সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়, তাহলে তা আমরা করব না। এটি আমাদের দেশের টিকে থাকার বিষয়। এর সঙ্গে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষার বিষয় জড়িত।’
অপর দিকে ন্যাটোতে যোগদানকে নিজেদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা হিসেবে দেখে কিয়েভ। ন্যাটো নিয়ে পুতিনের শর্তের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি হোয়াইট হাউস। ন্যাটো থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে সম্প্রতি হোয়াইট হাউস সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছিল, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। কিন্ত দেশটির নিরাপত্তার জন্য ন্যাটোর বিধানের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের মতো ভাষা ব্যবহার করা যাবে, এমন শর্তে রাজি হয়েছেন পুতিন। অনুচ্ছেদ–৫–এ বলা হয়েছে, ন্যাটোর কোনো সদস্য আক্রান্ত হলে অন্য সদস্যরা এগিয়ে আসতে পারবে।
তবে রাশিয়া এই যুদ্ধ শেষ করতে চায় না বলে মন্তব্য করেছেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। গতকাল তিনি বলেন, শান্তি নিয়ে চলমান আলোচনার মধ্যেও ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। ইউক্রেনের মুকাচেভো শহরে একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের স্থাপনায়ও হামলা হয়েছে। এ ছাড়া লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ডসহ ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। রাশিয়া অনিচ্ছাকৃতভাবে এসব করছে না, বরং এর মাধ্যমে দুঃসাহস দেখাচ্ছে দেশটি।
রয়টার্স
মস্কো