পারস্য উপসাগরের নীলাভ জলরাশির কোল ঘেঁষে দুবাই শহর। ভ্রমণপিপাসুদের আনন্দ দিতে কতশত আয়োজন সেখানে। আকাশচুম্বী ভবন থেকে শুরু করে সাগরের বুকে গড়ে তোলা কৃত্রিম দ্বীপ—জাঁকজমক আর বিলাসিতার কোনো কমতি নেই। শহরটির তাক লাগানো সব অবকাঠামোর তালিকায় এবার যুক্ত হতে যাচ্ছে একটি মসজিদ। পুরো মসজিদটিই গড়ে তোলা হবে থ্রিডি প্রিন্টার বা ত্রিমাত্রিক মুদ্রণযন্ত্রে। দুনিয়ার আর কোথাও এর আগে কোনো মসজিদ নির্মাণে এই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়নি।
দুবাই এককালে ছিল মৎস্যজীবীদের ছোট্ট এক গ্রাম। সেটা শত বছরেরও বেশি আগের কথা। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা সেকালের সেই গ্রামের আনাচকানাচে এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির শিল্পের স্পর্শ। তেমনই এক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থ্রিডি প্রিন্টিং। এই প্রযুক্তিতে অবকাঠামো গড়ে তুলতে ব্যবহার করা হয় বিশাল আকারের সব প্রিন্টার। সাধারণ ছাপার কাজে সচরাচর যেসব প্রিন্টার দেখা যায়, এগুলো কিন্তু তেমন নয়। কালির বদলে এই প্রিন্টারে ব্যবহার করা হয় নির্মাণ–উপাদানের মিশ্রণ। কম্পিউটারে ঢোকানো গাণিতিক হিসাব মেনে যন্ত্রের নলের অগ্রভাগ কংক্রিটের ওই মিশ্রণ দিয়ে আকার দেয় অবকাঠামোর একেকটা স্তরকে।
দুবাইয়ে মসজিদটির নির্মাণযজ্ঞ শুরু হবে এ বছরের শেষ নাগাদ। আশা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের শুরুর দিকে পুরো অবকাঠামো দাঁড় করানো যাবে। নকশা অনুযায়ী দোতলা মসজিদটির আয়তন হবে ২ হাজার বর্গফুট। এতে একসঙ্গে ৬০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। দুবাইয়ের ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড চ্যারিটেবল অ্যাকটিভিটিস ডিপার্টমেন্টের (আইএসিএডি) তত্ত্বাবধানে মসজিদটি নির্মাণ করা হবে।
থ্রিডি প্রিন্টার দিয়ে কেন এই মসজিদ নির্মাণের চিন্তা মাথায় আনা হয়েছে, তা নিয়ে কথা বলেছেন আইএসিএডির প্রকৌশল বিভাগের প্রধান আলী মোহাম্মদ আলহালইয়ান আলসুয়াইদি। তিনি বলছেন, প্রথাগত পদ্ধতিতে ভবন নির্মাণে সময় বেশি লাগে, ঝামেলাও কম হয় না। থ্রিডি প্রিন্টারে কম ঝামেলায় এবং কম সময়ে ভবনটি তৈরি করা যাবে। তবে কোন প্রতিষ্ঠান এই মসজিদ নির্মাণ করবে, তা এখনই প্রকাশ করতে চাননি তিনি।
শুধু এই মসজিদ নয়, গোটা দুবাইকেই থ্রিডি প্রিন্টারে তৈরি অবকাঠামো দিয়ে সাজানোর কাজ চলছে। এ নিয়ে ২০১৮ সালে সরকার একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। সে অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ দুবাইয়ের ২৫ শতাংশ নতুন ভবন থ্রিডি প্রিন্টারে গড়ে তোলা হবে। এই উদ্যোগ অনেকটাই এগিয়েছে। যেমন দুবাইয়ের পৌরসভা ভবনটি থ্রিডি প্রিন্টারের কীর্তি। ভবনটিই নতুন এই প্রযুক্তিতে তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো। দুবাইয়ে রয়েছে থ্রিডি প্রিন্টারে তৈরি প্রথম অফিস ও ড্রোন গবেষণাগারও।
বিশ্বের নানা প্রান্তে নির্মাণকাজে থ্রিডি প্রিন্টারের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জর্ডানের কথাও বলা যায়। সে দেশে শরণার্থীদের জন্য আবাসন তৈরিতে প্রযুক্তিটির ব্যবহার হয়েছে। আরও আছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অস্টিনে গৃহহীনদের জন্য তৈরি আবাসন, ৩ হাজার ৮০০ বর্গফুটের ক্যাম্প সুইফট সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং মেক্সিকোর পুরো একটি এলাকা। সব কটিই থ্রিডি প্রিন্টারে তৈরি।
নির্মাণকাজে থ্রিডি প্রিন্টিং নতুন প্রযুক্তি হলেও একেই ভবিষ্যৎ বলে মনে করছেন নেদারল্যান্ডসের আইন্দহোভেন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ট এনভায়রনমেন্টের ডিন থিও সালেত। থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মতো সব প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্মাণশিল্পের আধুনিকায়ন নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
থিও সালেতের ভাষ্যমতে, নির্মাণকাজে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সময় বাঁচাবে। কমাবে খরচ। লাগাম টানবে ভুলত্রুটিতে। এ ছাড়া দক্ষ নির্মাণশ্রমিকের যে সংকট, তারও সমাধান দেবে ডিজিটাল প্রযুক্তি। তৈরি হবে নির্মাণশিল্পে অবকাঠামোর নকশা নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ।
থিও সালেত বলছিলেন, ডিজিটাল নকশা আর নির্মাণকাজ সময় বাঁচাবে, নির্মাণ ব্যয় ও ত্রুটি কমাবে। তিনি মনে করেন, দুবাইয়ের প্রস্তাবিত মসজিদ থ্রিডি–মুদ্রিত স্থাপত্যনকশার পরবর্তী ধাপ; তবে এই নতুন প্রযুক্তির সামনে বেশ চ্যালেঞ্জ আছে।
এই ডাচ স্থপতি বলেন, ‘এ ধরনের বড় আকারের এবং দৃষ্টি আকর্ষক প্রকল্পের কাজের মানদণ্ড কেমন হবে, তা এখনো অজানা। সন্দেহ নেই, থ্রিডি প্রিন্টার নির্মাণকাজের ভবিষ্যৎ। তবে আমার মতে, এ প্রকল্প থেকে অনেক কিছু শিখতে হবে। এখনো থ্রিডিতে ভুলের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’