‘তোমরা আমার চোখ নিশানা করেছ, কিন্তু হৃৎস্পন্দন এখনো সচল আছে’

0
166
পুলিশ হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় সম্প্রতি ইরানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ফাইল ছবি: রয়টার্স

হাসপাতালের শয্যায় শায়িত এলাহে তাভাকোলিয়ানের ডান চোখ ব্যান্ডেজে মোড়া। আর বাঁ চোখটা বন্ধ। মুখে বিষাদের ছায়া। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি।

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ইরানের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশাদের কাছে বিক্ষোভ চলাকালে নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হন ইরানি তরুণী তাভাকোলিয়ান। গুলি তাঁর ডান চোখে লাগে। এতে এ চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন পিএইচডির এই ছাত্রী।

কিন্তু দুঃসহ এ ঘটনার মাত্র তিন মাস পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে ইরানি এই তরুণী তাঁর যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি ভিডিও শেয়ার করার সাহস দেখিয়েছেন।

ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ করে ওই পোস্টে এলাহে তাভাকোলিয়ান লেখেন, ‘তোমরা আমার চোখ নিশানা করেছ, কিন্তু আমার হৃৎস্পন্দন এখনো সচল আছে। আমার চোখ থেকে দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেওয়ার জন্য তোমাদের ধন্যবাদ। এটা বহু মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে।’

তাভাকোলিয়ান আরও লেখেন, ‘আমার হৃদয়ের ভেতরের আলো ও সামনে ভালো দিনের প্রত্যাশা আমার মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখবে। কিন্তু তোমাদের হৃদয় ও তোমাদের কমান্ডারের হৃদয় প্রতিদিন কালো থেকে আরও কালো হবে। শিগগিরই আমি একটি পাথুরে চোখ পাব আর তোমরা পাবে মেডেল।’

আমার হৃদয়ের ভেতরের আলো ও সামনে ভালো দিনের প্রত্যাশা আমার মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখবে। কিন্তু তোমাদের হৃদয় ও তোমাদের কমান্ডারের হৃদয় প্রতিদিন কালো থেকে আরও কালো হবে। শিগগিরই আমি একটি পাথুরে চোখ পাব আর তোমরা পাবে মেডেল।

এলাহে তাভাকোলিয়ান, গুলিতে এক চোখ হারানো ইরানি বিক্ষোভকারী

সম্প্রতি তাভাকোলিয়ান ইরান ছেড়েছেন। মাথা থেকে গুলি বের করতে ইতালিতে তাঁর বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে। হাসপাতালের শয্যা থেকে পোস্ট করা এক ভিডিওতে তিনি লিখেছেন, ‘এটা (দুঃসহ অভিজ্ঞতা) জানানোর জন্য আমি বাঁচতে চলেছি।’

অস্ত্রোপচারের প্রক্রিয়া শেষে তাভাকোলিয়ান বিবিসিকে বলেন, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে এ গুলি দেখানোর তাঁর ইচ্ছা আছে।

তাভাকোলিয়ান একাই নন

মাথায় স্কার্ফ ঠিকভাবে না পড়ার অভিযোগে আটক কুর্দি তরুণী মাশা আমিনি ইরানের পুলিশ হেফাজতে মারা যান গত বছর। এ ঘটনায় গত সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সরকাবিরোধী এ বিক্ষোভে অংশ নেয় লাখো জনতা।

বিক্ষোভ দমনে অভিযান শুরু করে পুলিশ। এতে আটক হন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। সহিংস বিক্ষোভে নিহত হন প্রায় ৫০০ জন। হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস নিউজ এজেন্সির তথ্য এটি।

আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁরা চোখ হারিয়েছেন, তাঁরা দাবি করেছেন, তাঁদের নিশানা করেই হামলা চালানো হয়েছে।

তবে ইরানের দাঙ্গা পুলিশের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কারামি দেশটির গণমাধ্যমে সম্প্রতি এমন অভিযোগ নাকচ করে দেন। তিনি বলেছেন, বিক্ষোভকারীদের ধরে ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁদের মুখমণ্ডলে গুলি করার যে অভিযোগ, তা তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার।

এমন অভিযোগকারীদের একজন আইনের শিক্ষার্থী ঘাজাল রানাজকেশ। গত নভেম্বরে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বন্দর আব্বাসে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। সচেতনতা বাড়াতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজের আহত হওয়া প্রসঙ্গে ২১ বছর বয়সী ছাত্রী ঘাজালই প্রথম প্রকাশ্যে পোস্ট দেন।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশাদের কাছে বিক্ষোভ চলাকালে নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে আহত হন এলাহে তাভাকোলিয়ান

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশাদের কাছে বিক্ষোভ চলাকালে নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে আহত হন এলাহে তাভাকোলিয়ান
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

হাসপাতালের শয্যা থেকে ঘাজালের শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা যায়, তাঁর ডান চোখ থেকে রক্ত ঝরছে। কিন্তু তিনি আঙুল উঁচিয়ে বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন।

এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এর মাধ্যমে ইরানিরা দেশের ভেতরে ও বাইরে এটাই দেখাতে চান, কীভাবে তরুণ বিক্ষোভকারীরা কর্তৃপক্ষের নিশানা হচ্ছেন।

ঘাজাল তাঁর ভিডিওর সঙ্গে লেখেন, ‘আপনারা আমাকে যখন গুলি করছিলেন, তখন কেন হাসছিলেন?’ তাঁকে সহায়তাকারী চিকিৎসাকর্মীদের কণ্ঠ শোনা যাওয়ায়, তাঁদের সুরক্ষার জন্য পরে এই ভিডিও সরিয়ে ফেলেন তিনি। তবে ঘাজাল এক নতুন কিছুই শুরু করেন।

ঘাজালের মতো একই রকমের আহত হওয়া তরুণ–তরুণীরা ভাবতে শুরু করেন, তাঁরা কেউ একা নন এবং তাঁরা একে অন্যকে মানসিকভাবে সহায়তা করতে একটা অনলাইন কমিউনিটি গড়ে তুলতে পারেন।

ইনস্টাগ্রামে ঘাজালের ব্যক্তিগত এক বিবৃতিতে লেখা হয়, ‘এসব চোখের ভাষা যেকোনো চিৎকারের চেয়ে বেশি।’

সম্প্রতি ঘাজাল তাঁর নতুন কিছু ছবি পোস্ট করেছেন। একটু ভালোভাবে না দেখলে, এগুলো ফ্যাশন ফটোগ্রাফি বলে মনে হতে পারে।

পোস্টে ঘাজাল রানাজকেশ লেখেন, ‘এই যন্ত্রণা অসহনীয়, কিন্তু আমি এটা সয়ে যাব। আমি বাঁচব কারণ, আমার গল্প অসমাপ্ত। আমাদের বিজয় এখনো আসেনি, তবে তা কাছেই।’

ঘাজালের ক্ষতিগ্রস্ত চোখের স্থানে কৃত্রিম চোখ বসানো হয়েছে। এটা মেনে নিতে তাঁকে যে শারীরিক–মানসিক লড়াই করতে হয়েছে, সে বিষয়েও লিখেছেন তিনি। তিনি বলেন, মুখমণ্ডলের ক্ষতকে তিনি মানিয়ে নিয়েছেন, এমনকি এর জন্য গর্বও অনুভব করেন। যে প্লাস্টিক সার্জারির মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে, তা ছিল খুব কষ্টদায়ক।

এখনো লড়াকু মানসিকতা ধারণ করেন ইরানি এই শিক্ষার্থী। সেই মানসিকতা ফুটে উঠেছে তাঁর কথায়, ‘আমি এক চোখেই স্বাধীনতার সাক্ষী হয়ে রইব।’

‘জীবন্ত প্রমাণ’

এলাহে তাভাকোলিয়ান ও ঘাজাল রানাজকেশের মতো ঠিক কতজন ইরানজুড়ে ওই বিক্ষোভকালে আহত হয়েছেন, তা কেউ জানেন না।

হাসপাতালে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কায় আহত বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ আদৌ চিকিৎসাই নেননি বলে জানা গেছে।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, একই রকম আহত হয়েছেন এমন ৫০০ জন গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে তেহরানের তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

মোহাম্মদ ফারজি (৩২) তেহরানের একজন স্ট্রিট পারফরফার। সেপ্টেম্বরে তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। শটগানের একধরনের গুলি ‘বার্ডশট’ তাঁর চোখে লাগে। তিনি বলেন, ‘আমি এর জন্য দুঃখিত নই। আমি গর্বিত এ জন্য যে আমি জনগণের স্বাধীনতার জন্য আমার চোখ হারিয়েছি।’

ঝুঁকি থাকলেও মোহাম্মদ ফারজি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। তাঁর চোখটা হয়তো বাঁচানো যেত। কিন্তু তাঁর টাকাপয়সা ফুরিয়ে যায় ও তৃতীয় দফা অস্ত্রোপচারের আগে চিকিৎসা বন্ধ করতে বাধ্য হন।

মোহাম্মদ জাফর ঘায়েমপানাহ একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞ। ইরানের ৪০০ চক্ষুরোগ চিকিৎসক দেশটির কর্তৃপক্ষের কাছে লেখা এক চিঠিতে আহত বিক্ষোভকারীদের আরও চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানান। মোহাম্মদ জাফর এই চিকিৎসকদের একজন।

ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে এই চিকিৎসক বলেন, ‘চোখ হারানো এসব তরুণ বিক্ষোভকারী সমাজে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে রইবেন। যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন তাঁরা ইরানি কর্তৃপক্ষের দমনাভিযানের জীবন্ত প্রমাণ হয়েই থাকবেন।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.