আলোকবর্তিকা হাতে লাখো প্রাণের মাঝে আলোর সন্ধানে এক উজ্জ্বল যাত্রাপথে হেঁটে চলেছেন এ যুগের বাতিঘর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সাল, তারিখ, বছরের হিসাবে তাঁর বয়স ৮৪। তবে ৮৪ সংখ্যামাত্র। তিনি চিরনবীন, চিরতরুণ। সৃষ্টির আনন্দে তিনি উদ্ভাসিত। তিনি যৌবনের দূত, জানার অন্তহীন পিপাসা এখনো তাঁকে সমান তাড়িত করে চলে। এখনো বিস্মিত হন নতুনকে পেয়ে। প্রজ্বলিত করার অসাধারণ ক্ষমতা যাঁর, তাঁর সাহচর্য পাওয়ার আনন্দে জন্মদিনের ক্ষণে আজ এই প্রণতি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর যাপিত জীবনে যা চর্চা করেন, তা চর্চা করতে পারা বা ধারণ করতে পারা সহজ নয়। তাঁর অপার প্রাণশক্তি, অদম্য ইচ্ছাশক্তি, উন্নত মানুষ হয়ে ওঠা, উন্নত মানুষ গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞ বিস্ময় জাগায়, অনুপ্রাণিত করে তোলে। রবীন্দ্রনাথের পঙ্ক্তিতে বলি,
‘তোমার সভায় কত-না গান
কতই আছেন গুণী—
গুণহীনের গানখানি আজ
বাজল তোমার প্রেমে।’
পড়া, পড়া এবং পড়া
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, পড়ো-পড়ো-পড়ো, পড়তে থাকলে দেখবে পৃথিবীতে জীবন পরিবর্তন করে দেওয়া কত লেখা আছে। তিনি আরও বলেন, একটা বই প্রথমবার যখন পড়া হয়, তখন একটিমাত্র বিষয় সামনে আসে। যখন দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার পড়া হয়, তখন সব কটি দিক উন্মোচিত হতে থাকে। তিনি ভালো বই একবার নয়, বারবার পড়তে বলেন। আজীবন পড়াকেই তিনি করেছেন সাধনা। বই পড়ে আরও একটু উন্নততর মানুষ হয়ে ওঠার মন্ত্রে তিনি দীক্ষিত করেন সবাইকে। এই যে পড়াকে সাধনা করে তোলা, তা কি খুব সহজ! সহজ নয়, তবে কঠিন কাজটিকেই সহজ করে তুলেছেন তিনি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, প্রতিদিন হাজার ব্যস্ততা থাকতেই পারে কিন্তু প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ পাতা পড়ার অভ্যাসটা গড়ে তোলা জরুরি। কেবল পড়া নয় তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়ার ওপরও সমান গুরুত্ব দেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো পড়ার সঙ্গে নিত্য যাঁর বসবাস, তিনি বলেন জীবনে কিছুই তো পড়া হয়নি!
কবিতায় বসবাস
কবিতা পড়েন, কবিতা ভালোবাসেন এমন মানুষকে চারপাশে পাওয়া গেলেও তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে একজন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কবিতায় বসবাস করেন। তাঁর ভেতরে বসবাস করে অসংখ্য কবির হৃদয়নিংড়ানো শব্দগুচ্ছ। তাঁর চলতি কথোপকথনের মধ্যেই জুড়ে যায় কবিতার লাইন। কথার মধ্যে তিনি যখন আবৃত্তি শুরু করেন, তাঁর মুখে যেন প্রতিফলিত হয় এক উজ্জ্বলতর আলো। আনন্দের আলো, কবিতার আলো। সে আলো শ্রোতাকেও আলোড়িত করে। তিনি বলেন, কবিতা সেটাই যেটা বোঝার আগেই হৃদয়ের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। মৌলিক আবেগকে আলোড়িত করতে পারে কবিতা। কবিতা আবৃত্তি করলেই কবিতার প্রাণ জেগে ওঠে। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি তাঁর। অসংখ্য কবিতা তার ঠোঁটের ডগায়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, প্রতিদিন কবিতা পড়বে তাহলে ভেতরটাও কবিতার মতো মসৃণ হবে। কবিতার মধ্যে যে লাবণ্য আছে, মাধুর্য আছে, তা জীবনাচরণের মধ্যে লেগে গেলে আলোক ছড়াবে। তাঁর নিত্যকথনে কবিতাদের এই ছড়াছড়ি তাঁর ভেতরের মসৃণতারই সন্ধান দেয়। কবিতার সঙ্গে সখ্য গড়তে অনুপ্রাণিত করে।
আধমরা দে ঘা মেরে…
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই গভীরতর একটা মানুষ আছে। উসকে দেওয়ার বা প্রজ্বলিত করে দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের। তিনি বলেন, নিজের আগুনে নিজে জ্বলে উঠতে হবে। অন্যকে বড় ভাবতে গিয়ে নিজেকে ছোট ভেবো না। তাঁর চারপাশের মানুষকে তিনি প্রজ্বলিত করে চলেন, মানুষের ভেতরের মানুষটাকে বের করে এনে ভালো কাজে, বড় কাজে, আনন্দময় কাজে লাগতে উৎসাহিত করে তোলেন। তিনি বলেন, মানুষকে প্রতিযোগিতা করতে হয় নিজের সঙ্গে। আমার অপারগতার সঙ্গে আমার সক্ষমতার লড়াই। যার যেখানে সম্ভাবনা সেটুকুকে উসকে দিয়ে সামনে এগিয়েও যাওয়ার মন্ত্র শোনান তিনি। যে জীবনটা পেয়েছি, সেই জীবনটা কীভাবে ব্যয় করছি, তা নিয়ে ভাবতে আগ্রহী করে তোলেন। তিনি বলেন, তোমার যতটুকু ক্ষমতা, তোমার যতটুকু শক্তি, তার সর্বোচ্চটাই তোমাকে দিতে হবে। প্রচণ্ড পরিশ্রমী এই মানুষটা বিশ্বাস করেন, প্রতিমুহূর্তের পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মানুষ তৈরি হয়। মানুষের শ্রমের চেয়ে ভয়ংকর কোনো শক্তি আর নেই। পরিশ্রমকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি আরও বলেন, তুমি যা পরিশ্রম করবে, সেটাই তোমার দৈব। জীবনকে তৈরি করে নিতে হয়। প্রতিদিন দুটি ঘণ্টা ভালো কাজ করো, ৫০ বছর পরে গিয়ে দেখবে বড় একটা কাজ হয়েছে। নিজেকে চিরে চিরে, প্রশ্ন করে সত্য খোঁজার, নিজেকে খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
সংগঠক
সারা দেশের লাখো লাখো মানুষকে বইপড়ুয়া করে আরও একটু উন্নততর মানুষ করে তোলার এক অনন্য আন্দোলনের পুরোধা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। গড়ে তুলেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠান, যা শিল্পসাহিত্যচর্চায় চার দশকের বেশি সময় ধরে অবদান রেখে চলেছে। মানুষকে সংগঠিত করার এক ক্যারিশমাটিক ক্ষমতার অধিকারী তিনি। তিনি বলেন, ভালোবাসা, সহযোগিতা ও প্রেম নিয়ে মানুষ শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, একা বিষয়টি স্বার্থপরতা, একা বিষয়টা ছোট। তাই একা ভালো কিছু করা যায় না।
কেবল শিল্পসাহিত্যই নয়, পরিবেশ আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা অনন্য। এখনো সংগঠন গড়ে তোলার শক্তি সমানভাবে ধারণ করেন তিনি। সংগঠনমূলক কাজে এখনো তাঁর সমান অংশগ্রহণ। তাঁর চারপাশের মানুষদের মধ্যে সংগঠক সত্তাকে উসকে দিতে নিয়তই কাজ করে চলেন তিনি।
কথার জাদুকর
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যখন বলেন, তখন তাঁর চারপাশের মানুষগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন, সম্মোহিত হয়ে শোনেন। কথার জাদুতে সম্মোহিত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর। খুব সাধারণ কথোপকথন হোক বা কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা হোক গল্প, কবিতা, ঘটনা দিয়ে নিখুঁত শব্দচয়নে, স্পষ্ট উচ্চারণে, কণ্ঠের অপূর্ব ওঠা-নামায় তাঁর বলা কথাগুলোও সুরেলা হয়ে ওঠে যেন। নিজেই কেবল স্পষ্ট উচ্চারণে সুন্দর করে কথা বলেন, তা নয়, অন্যদের তিনি সুন্দর করে কথা বলতে অনুপ্রাণিত করে তোলেন। কথা বলার মধ্যে প্রাসঙ্গিক গল্প, কবিতা, ঘটনারা শ্রোতার মনোযোগ বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। তাঁর হাস্যরসাত্মক সত্তা তাঁর কথাকে শ্রোতার কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। মানুষকে হাসানোর ক্ষমতাও তার অপার। তিনি বলেন, হাসি পুরো পরিবেশ সুন্দর করে দেয়। এই কথার জাদুকরের কথার মোহে পুরো বাংলাদেশ বুঁদ হয়ে আছে দশকের পর দশক ধরে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে কাছ থেকে দেখা পরম সৌভাগ্যের। তাঁর গুণের খতিয়ান এত অল্পতে বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি বলেন, আমরা কেঁচো, সাপ হয়ে জন্মায়নি। মানুষের জীবন পেয়েছি। এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি। মনুষ্য জীবনের সবকিছুই প্রাপ্তি। মানুষকে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করে তিনি বলেন, পৃথিবীতে তুমি কি চাও, এইটা যদি নির্ধারণ করতে না পারো, তাহলে অনেক কিছুই বাদ পড়ে যাবে। স্বপ্নকে গুরুত্ব দেওয়া, মানুষকে উন্নততর মানুষ করে তোলার যে ব্রত তিনি পালন করে চলেছেন, সেই ব্রতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠার লক্ষ্য ছড়িয়ে পড়ুক হাজারো অন্তরে। তিনি শতবর্ষ অতিক্রম করুন। জন্মদিনে এই রইল প্রণতি।