খণ্ডকালীন কাজ খুঁজতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন সাবেক সচিবসহ হাজারো মানুষ
ফেসবুকে খণ্ডকালীন কাজের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখতে পান অবসরপ্রাপ্ত এক অতিরিক্ত সচিব। এতে বলা ছিল– ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের জন্য অনলাইনে ১৫-২০ মিনিট কাজ করে দিনে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। কৌতূহলী হয়ে তিনি যোগাযোগ করেন। ফোনে কথোপকথনের মাধ্যমে তাঁকে পণ্য কেনার ফাঁদে ফেলে ধাপে ধাপে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫৮৩ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এর পর মুনাফাসহ টাকা ফেরত দেওয়ার নামে কর হিসেবে চাওয়া হয় আরও পৌনে ৬ লাখ টাকা। এ পর্যায়ে সন্দেহ হওয়ায় তিনি মামলা করেন।
তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, অসাধু তিন চীনা নাগরিকসহ পাঁচজনের একটি চক্র প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে। অনলাইনে খণ্ডকালীন কাজে প্রচুর অর্থ আয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা লোকজনকে প্রলুব্ধ করে। গত সাড়ে চার মাসে এভাবে হাতিয়ে নেওয়া কোটি কোটি টাকা তারা হুন্ডির মাধ্যমে চীনে পাচার করেছে। প্রতি মাসে তারা হাতিয়েছে অন্তত ৫০ লাখ টাকা। চক্রের হোতা ডেং শোয়াইমিং চীনে অবস্থান করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তার প্রতিনিধি হিসেবে এ দেশে কাজ করছিল ঝ্যাং পিং ও ঝ্যাং ইরউয়া। তাদের স্থানীয় সহযোগী ছিল সিয়াম চৌধুরী ও আবীর হোসেন।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, একজন ভুক্তভোগীর করা মামলার তদন্তে নেমে চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করে ডিবি। তাদের চারজনকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ১৫টি স্মার্ট ফোন, পাঁচটি ফিচার ফোন, একটি ল্যাপটপ, সচল বিকাশ, নগদ অ্যাকাউন্টসহ প্রায় ৩ হাজার সিমকার্ড, একটি রাউটার, দুটি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। এই চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছে হাজারো মানুষ।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতারক চক্রের বিজ্ঞাপন দেখে সাধারণ মানুষ তাদের হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, টেলিগ্রামের নানা চ্যানেল ও লিংকে যুক্ত হয়। চীন থেকে এই ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমগুলো পরিচালনা করা হয়। তারা নিয়োগ বা খণ্ডকালীন কাজের বিজ্ঞাপন দিলেও লোকজনকে অ্যামাজনের ভুয়া সাইট থেকে পণ্য কেনার প্রস্তাব দিত। বিনিময়ে ১০-১৫ শতাংশ কমিশনের প্রলোভন দেখাত। অর্থাৎ কেউ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে পরে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা ফেরত পাবে। অবশ্য পণ্যটি হাতে পাবে না। এভাবে ভার্চুয়াল কেনাকাটায় তাদের পণ্যের রেটিং বাড়ে বলে গ্রাহককে বোঝানো হতো। মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য প্রথমে অল্প দামের পণ্য কেনার পর কমিশনসহ টাকা ফেরত দিত তারা। পরে ধাপে ধাপে লাখ টাকার ওপরে ট্রানজেকশনের (পণ্য কেনা) নির্দেশনা আসত। গ্রাহক বড় অংকের টাকা দিয়ে পণ্য কিনলে জুড়ে দেওয়া হতো নানা শর্ত। সেসব শর্ত পূরণ না করলে গ্রাহকের ইতোমধ্যে জমা দেওয়া টাকার মুনাফা ও মূলধন ফেরত দেওয়া হবে না বলে জানাত। শেষে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সব ডিজিটাল মাধ্যম থেকে ব্লক করে দিত প্রতারকরা।
যেভাবে গড়ে ওঠে প্রতারণার চক্র
চক্রের হোতা ডেং শোয়াইমিং চীনে অবস্থান করে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের কাছাকাছি নামের ডোমেইন অ্যামাজন ৯৯ ডটকম, অ্যামাজন ৯৫ ডটকম, অ্যামাজনস ডটকম কিনে নেয়। এর পর বাংলাদেশি সহযোগীদের সহায়তায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় ওই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়। শোয়াইমিং তার প্রতিনিধি হিসেবে ঝ্যাং পিং ও ঝ্যাং ইরউয়াকে বাংলাদেশে পাঠায়। তারা এখানে আবীর হোসেন ও সিয়াম চৌধুরীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। প্রযুক্তির নানা বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা থাকায় চীনা দুই নাগরিক প্রযুক্তির অপব্যবহার করে টাকা হাতানোর প্রস্তাব দেয়। পরে তারা ডিজিটাল মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলে অ্যামাজনসহ নামিদামি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নাম ও ছবি ব্যবহার করে প্রতারণা শুরু করে।
গ্রেপ্তার আবীর ও সিয়াম জানিয়েছে, চীনে লেখাপড়া করতে গিয়ে এই চক্রের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। দেশে ফেরার পরও তাদের যোগাযোগ ছিল। পরে তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া শুরু করে। তারা প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া অর্থ থেকে বেতন ও লভ্যাংশ পেত। তবে সিংহভাগ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চীনে পাচার করা হতো।