রাজধানীর তেজগাঁওয়ের শহীদ মনু মিঞা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল ৬৬ জন। তাদের মধ্যে পাস করেছে ৪২ জন (প্রায় ৬৪ শতাংশ)। তবে ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র একজন।
গত বুধবার ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে কথা হয় প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানার সঙ্গে। তিনি বলেন, বেসরকারি থেকে সরকারি হওয়া এই বিদ্যালয়টিতে এখন মোট শিক্ষার্থী ৪১৫ জন, কিন্তু শিক্ষক আছেন মাত্র ৭ জন। অথচ দরকার ছিল ২৫ জন। আবার শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই শ্রমজীবী পরিবারের। এ কারণে এমন ফলাফল হয়েছে।
এমন ফলাফলের কারণ হিসেবে শহীদ মনু মিঞা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কথার যুক্তি হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু সেই বিদ্যালয় থেকে আনুমানিক দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তেজগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকেও এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে কম শিক্ষার্থী। এই বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল ২৪৩ জন, পাস করেছে ২৩৭ জন। আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৪ জন। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর হার প্রায় ১৪ শতাংশ। গতবার এই বিদ্যালয় থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছিল ৪৯ জন। প্রধান শিক্ষক শাহীন খান বলেন, এবার বিজ্ঞান শাখায় পরীক্ষার্থী কম ছিল। জিপিএ-৫ কমার জন্য এটি একটি কারণ হতে পারে।
ঢাকা মহানগরে অবস্থিত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে, হাতেগোনা তিন-চারটি বাদে বাকি বিদ্যালয়গুলোর সব কটিতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী কম। অবশ্য দুই-তিনটি বাদে বাকি সরকারি বিদ্যালয়গুলোর পাসের হার ৯০ শতাংশের বেশি।
ঢাকা মহানগরের ৩৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৩টি শাখা (ফিডার শাখা নামে পরিচিত) রয়েছে। এই বিদ্যালয়গুলো সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং অবকাঠামোগত সুবিধায় বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর ফলাফল, বিশেষ করে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর হার সরকারি বিদ্যালয়গুলোর চেয়ে বেশি।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এস ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা, ঢাকায় ভালো বেসরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় সরকারি বিদ্যালয়ে জবাবদিহি ও শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্ন কম হয়। অনেক শিক্ষক বিদ্যালয়ের চেয়ে কোচিং-প্রাইভেটের প্রতি বেশি মনোযোগী। বেসরকারি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও প্রধান শিক্ষক যেভাবে শিক্ষকদের তদারকি করতে পারেন, সেটা সরকারি বিদ্যালয়ে কম হয়।
গত রোববার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় এবার পাসের হার ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার প্রায় ৮৪ শতাংশ। এবার ঢাকা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৯ হাজার ১৯০ জন পরীক্ষার্থী, যা গতবারের চেয়ে ৩ হাজারের বেশি।
ঢাকা মহানগরীর ৩৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৩টি বিদ্যালয়ের ফলাফলের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের গড় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার হারের দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে আছে নতুন প্রতিষ্ঠিত আশকোনা হজ্জক্যাম্প এলাকায় অবস্থিত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল ১৩৩ জন। পাসের হার শতভাগ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ১১০ জন শিক্ষার্থী, যা মোট পরীক্ষার্থীর হিসেবে প্রায় ৮৩ শতাংশ।
তবে নতুন প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ের ফলাফল উভয় সূচকে ভালো হলেও পুরোনো সরকারি বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশের জিপিএ-৫–এর সংখ্যা ও হার কম। যেমন নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল ২৬৬ জন। পাসের হার ৯৫ শতাংশের বেশি হলেও জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ১৬ জন। একসময় সুনাম থাকা এই বিদ্যালয় পুরান ঢাকার কাপ্তানবাজার এলাকায় অবস্থিত। ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির প্রথমে নাম ছিল প্রিয়নাথ হাইস্কুল। পরে ১৯৫১ সালে বিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণে এলে নাম পরিবর্তন করে নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় রাখা হয়।
পুরান ঢাকার আরেকটি সরকারি বিদ্যালয় ইসলামিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। এখান থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল ৮৩ জন শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৯ জন।
আজিমপুর গভ. গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল ৪৯১ জন। গড় পাসের হার প্রায় ৮৬ শতাংশ, তবে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪১ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৮ শতাংশের মতো।
অথচ পাশের এলাকার একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের ৫৪৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩০২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে, যা শতকরা হিসেবে ৫৫ শতাংশ।
শ্যামপুর সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৫২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১০ জন। লালবাগ সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২৬৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৫ জন। শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৫ শতাংশের কিছু বেশি। শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের চিত্রও প্রায় কাছাকাছি।
মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২৮৬ জন পরীক্ষা দিয়েছিল। গড় পাসের হার ৯৭ শতাংশের বেশি হলেও জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৯ জন, যা মোট পরীক্ষার্থী হিসেবে ২৪ শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী বেসরকারি বিদ্যালয় মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ৭৪২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে শুধু জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৮৩ জন (৬৫ শতাংশ)।
এগিয়ে সরকারি চার বিদ্যালয়
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি উচ্চবিদ্যালয় (৮৩ শতাংশ) ছাড়াও সরকারি বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ধানমন্ডি এলাকার গভ. ল্যাবরেটরি হাইস্কুল (৫৪ শতাংশ), ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল (৪৪ শতাংশ), মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় (৫৭ শতাংশ) ও মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে (৫৯ শতাংশ) জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর হার তুলনামূলক বেশি। যদিও তা ঢাকার সুপরিচিত বেসরকারি কিছু বিদ্যালয়ের তুলনায় পিছিয়ে। যেমন ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ফলাফল এবার গতবারের চেয়ে খারাপ হয়েছে। তারপরও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ শতাংশের কিছু বেশি। আবার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল ৭৮০ জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৫৮ জন শিক্ষার্থী (৯৭ শতাংশের বেশি) এবং গড় পাসের হার শতভাগ।
মাউশির আরেক সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুকের মূল্যায়ন হলো কোচিং-প্রাইভেটের প্রবণতা সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই আছে। তবে নানা কারণে ঢাকায় ভালো শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে। কিন্তু জেলা শহরে এখনো কিন্তু সরকারি বিদ্যালয়গুলো ভালো করছে; সেখানে মানুষের আগ্রহ এখনো সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতি। আসলে ঢাকায় পরিচিত বেসরকারি বিদ্যালয়ে তদারকি বেশি হয়, যা ঢাকার সরকারি বিদ্যালয়ে ঘাটতি আছে।