মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে স্বামী ভুবন চন্দ্র শীল দুই দিন ধরে হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন। স্ত্রী রত্না রানী শীল জানেন না তাঁর স্বামীর জ্ঞান আর ফিরবে কি না। চিকিৎসকেরা তাঁকে এখন পর্যন্ত কোনো আশার কথা শোনাতে পারেননি। চিকিৎসকেরা শুধু বলেছেন, ভুবনের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত অস্ত্রোপচারও সম্ভব নয়। এমন অনিশ্চয়তা নিয়েই একমাত্র মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীলকে নিয়ে দুই দিন ধরে হাসপাতালের সিঁড়িতে অপেক্ষায় আছেন রত্না রানী শীল।
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় সোমবার রাত ১০টার দিকে প্রাইভেট কার আরোহী এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় একদল সন্ত্রাসী। সেই গুলি লেগেছিল মোটরসাইকেল আরোহী ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায়। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে ওই রাতেই তাঁকে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
আজ বুধবার বিকেলে পপুলার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ভুবনের স্ত্রী রত্না রানী শীল ও তাঁর সদ্য এসএসসি পাস করা মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীল সিঁড়িতে বসে আছেন। তাঁদের বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। কেউই তেমন কোনো কথা বলছিলেন না। পরিচয় পেয়ে কথা বলতে শুরু করেন রত্না রানী শীল। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর মতো এমন দুর্ভাগা হয়তো আর কেউ নেই। পথ দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ মাথায় গুলি লাগল। এখন তো চিকিৎসকেরাও বলতে পারছেন না, তিনি বাঁচবেন কি না। কোনো আশা দেখাচ্ছেন না।’
ভুবন চন্দ্র শীল গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। গুলশানে তাঁর কার্যালয়। রাতে কাজ শেষে সেখান থেকে মতিঝিলের আরামবাগের বাসায় ফেরার পথে তিনি গুলিবদ্ধ হন। আরামবাগের বাসায় তিনি একাই থাকতেন। তাঁর স্ত্রী রত্না রানী শীল একমাত্র সন্তানকে নিয়ে থাকেন নোয়াখালীর মাইজদীতে। রত্না মাইজদীর একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভুবনের বাবা কৃষ্ণ কুমার শীল মারা গেছেন ২৩ বছর আগে। ভুবনের মা গিরিবালা শীলের বয়স ৭৫ বছর। তিনি ভুবনের স্ত্রী রত্না রানী শীলের সঙ্গে থাকেন। তিনিও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেয়েছে, কথা বলতে পারেন না। ভুবন মা–বাবার একমাত্র সন্তান।
রত্না রানী শীল বলেন, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার তাঁদের। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। এমন পরিস্থিতিতে ভুবনের চিকিৎসা ব্যয় নিয়েও আছেন দুশ্চিন্তার মধ্যে। প্রকাশ্য রাস্তায় এমন একটা ঘটনা ঘটল, একজন নিরপরাধ মানুষের এমন পরিণতি হলো, অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কেউ খোঁজ নিল না।
রত্নার ভাই তাপস মজুমদার ভগ্নিপতির চিকিৎসকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। তিনি বলেন, আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো কথা চিকিৎসকেরা বলতে পারেননি। ওনাকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি টাকা খরচ হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শী যা বললেন
ভুবন চন্দ্র আরামবাগ যাচ্ছিলেন পাঠাও চালক শামীম হোসেনের মোটরসাইকেলে চড়ে। শামীম বলেন, ওই দিন কুড়িল বিশ্বরোডের শেওড়া থেকে ভুবন চন্দ্রকে নিয়ে আরামবাগে যাচ্ছিলেন তিনি। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বিজি প্রেসের বিপরীতে প্রধান সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় যানজট ছিল। মোটরসাইকেলটি ধীরগতিতে চালাচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ বিকট দুটি শব্দ হয়। তখনই পেছনের যাত্রী ভুবন চন্দ্র শীল তাঁর ওপর হেলে পড়েন। এ সময় ভুবনের মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। পরে দেখা যায়, তাঁর মাথায় আঘাত লেগেছে। তাঁকে দ্রুত একটি গাড়িতে করে শমরিতা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শীর্ষ সন্ত্রাসী মামলা করেননি, মামলা করেছেন ভুবনের স্ত্রী
পুলিশ জানিয়েছে, ওই রাতে সাত-আটজন সন্ত্রাসী চারটি মোটরসাইকেলে এসে তেজগাঁও শিল্প এলাকার সিটি পেট্রলপাম্প ও বিজি প্রেসের মাঝামাঝি রাস্তায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনের প্রাইভেট কার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। তাৎক্ষণিক প্রাইভেট কার থেকে মামুন ও তাঁর দুই সহযোগী মিঠু ও খোকন নেমে পড়েন। এ সময় সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মামুনের পিঠ ও ঘাড়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। সন্ত্রাসীদের করা গুলি গিয়ে লাগে ভু্বন চন্দ্র শীলের মাথায়।
শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন এখন শুক্রাবাদের একটি বাসায় অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। মামুনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া এবং কুপিয়ে আহত করা হলেও তিনি মামলা করেননি। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা সাত-আটজনকে আসামি করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেছেন ভুবন চন্দ্র শীলের স্ত্রী রত্না রানী শীল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের শিল্পাঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) আরিফ রাইয়ান বলেন, যেহেতু ভুক্তভোগী ভুবনের অবস্থা বেশি গুরুতর, এ কারণে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা নেওয়া হয়েছে। মামলাটি যেন শক্ত হয়, সে জন্যই ভুবনের স্ত্রীকে মামলার বাদী করা হয়েছে। তবে পুরো ঘটনার বর্ণনা এজাহারে রয়েছে।
হামলায় আহত সন্ত্রাসী মামুন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি। ২৪ বছর কারাবাসের পর সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্ত হন। পুলিশের ধারণা, কারাগারে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের নির্দেশে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও মামুন একসময় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিলেন। তাঁদের গড়ে তোলা বাহিনীর নাম ছিল ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। তাঁরা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি। ইমন এখনো কারাগারে। মামুন কারাগারে থাকা অবস্থাতেই দুজনের বিরোধ দেখা দেয়। ওই বিরোধের জেরে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা মামুনের।