বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডে ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রনজিত কুমার নামের এক ব্যক্তিকে, যিনি নাটোরের সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি।
রনজিত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও একান্ত সহকারী সচিব ছিলেন। প্রতিমন্ত্রীর বাড়ি নাটোরের সিংড়ায়। তিনি নাটোর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
দুজন জনপ্রশাসন ও সরকারি চাকরির নিয়মকানুনের বিশেষজ্ঞ বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনের পদে থাকতে পারেন না।
বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডে (বিডিসিসিএল) রনজিতের বাইরে আরও একজনের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি হলেন মো. ইকরামুল হক, যিনি নিয়োগ পেয়েছেন ব্যবস্থাপক (লজিস্টিক) হিসেবে। তিনিও প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁকে নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বয়সসীমা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত শিথিল রাখা হয়েছিল।
বিষয়টি নিয়ে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, ডাটা সেন্টার একটি আলাদা কোম্পানি। সেখানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আছেন, নিয়োগের কমিটি আছে। মন্ত্রণালয়ের বাইরের কোম্পানি। তিনি বলেন, যে দুজনের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা নিয়ম মেনে পদত্যাগ করে নতুন চাকরিতে যোগদান করেছেন।
রনজিত কুমারের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তিনি চাইলে রাজনৈতিক পদ ছেড়ে দিতে পারেন। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কিছু বলার নেই।
ডিজিটাল জগতে মানুষের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষিত থাকে ডাটা সেন্টারে। তাই এ ধরনের স্থাপনাকে খুবই স্পর্শকাতর হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি ডাটা সেন্টার করেছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে। এটি পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড বা বিডিসিসিএল শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি।
নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন
২০২২ সালের ২৯ এপ্রিল বিডিসিসিএলে কারিগরি (টেকনিক্যাল) ও সাধারণ (নন-টেকনিক্যাল) মিলিয়ে ৪১টি পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিটিতে দেখা যায়, শুধু পাঁচটি পদে নিয়োগে বয়সসীমা শিথিল করা হয়েছে—ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং), ব্যবস্থাপক (লজিস্টিকস), নিরাপত্তা কর্মকর্তা, স্টোর কিপার ও নিরাপত্তারক্ষী। শুধু আইসিটি বিভাগ ও এর অধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের জন্য শর্ত শিথিল করা হয়েছে তিনটি পদে—ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং), ব্যবস্থাপক (লজিস্টিকস) ও স্টোর কিপার।
শর্তে বলা হয়েছে, আইসিটি বিভাগ এবং এর অধীন দপ্তর ও সংস্থায় কর্মরত প্রার্থীদের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা বিবেচনায় অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে বয়সসীমা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলযোগ্য। এই শর্তের অধীনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ইকরামুল হককে। এই পদের সমপর্যায়ের (গ্রেড-৫) পদ রয়েছে আরও চারটি। তিনটিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা হয়নি। এই পদগুলোতে বেতন মাসে ৮৪ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইসিটি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত শিথিল রাখা হয়।
ব্যবস্থাপক (লজিস্টিক) পদের বয়সসীমা ছিল অনূর্ধ্ব-৩৭ বছর। নিয়োগ পাওয়া ইকরামুল হকের আবেদন অনুযায়ী, আবেদনকালে তাঁর বয়স ছিল ৪৫ বছরের বেশি। তিনি যশোরের ঝিকরগাছার শহীদ মশিয়ুর রহমান সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে ‘ব্যাচেলর অব সায়েন্স’ ডিগ্রি অর্জনকারী।
ইকরামুল হক বলেন, তাঁর জন্য নিয়োগের শর্ত শিথিল হয়েছে, তা তিনি মনে করেন না। তিনি গত জানুয়ারিতে ডাটা সেন্টারে যোগ দেন। তিনি বলেন, ২০১২ সাল থেকে তিনি আইসিটি বিভাগে কাজ করেছেন। বর্তমান প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাত-আট বছর ছিলেন।
ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং) পদে নিয়োগ পাওয়া রনজিত কুমারের আবেদনে উল্লেখ আছে, তিনি গোল-ই-আফরোজ সরকারি কলেজ নাটোর থেকে ২০১১ সালে ব্যাচেলর অব আর্টস সম্পন্ন করেছেন। তিনি ২০১৫ সাল থেকে আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং ২০১৯ সাল থেকে একান্ত সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং) পদের নিয়োগের অন্যতম শর্ত ছিল, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সহকারী ব্যবস্থাপক বা সমপদে ন্যূনতম পাঁচ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
রনজিতের নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সের সমস্যা ছিল না। কিন্তু তিনি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নাটোর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইসতিয়াক আহমেদ জানান, রনজিত কুমার ২০২২ সালের অক্টোবরে গঠিত সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে সহসভাপতি হিসেবে পদ পান। তাঁকে সম্প্রতি ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অবশ্য রনজিত গতকাল বুধবার রাতে কাছে দাবি করেন, তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কোনো পদে নেই। চাকরি পাওয়ার আগেই পদত্যাগ করেছেন। কথা বলার একপর্যায়ে তিনি দাবি করেন, কোম্পানি আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক সংগঠনের পদে থাকলে সমস্যা নেই।
রনজিত কুমার ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বিডিসিসিএলে যোগ দেন। উল্লেখ্য, ১ মে সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের দপ্তর সম্পাদক আবু তোহা তালুকদারের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে সভাপতির অনুপস্থিতিতে রনজিতকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানানো হয়।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না। এ ছাড়া বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।
বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জোহরা বেগম বলেন, রনজিতের রাজনৈতিক সংগঠনের পদে থাকার বিষয়টি তিনি এই প্রতিবেদকের কাছেই শুনেছেন। বিষয়টি তিনি দেখবেন বলে জানান।
‘প্রশ্ন উঠতেই পারে’
বিডিসিসিএলের নিয়োগে সাধারণ (নন-টেকনিক্যাল) পদগুলোর পরীক্ষা হয় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে। যার মধ্যে ৯ জন কর্মকর্তা ও ২ জন কর্মচারীর নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। কারিগরি পদগুলোয় পরীক্ষা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে)। এসব পদে নিয়োগ এখনো হয়নি।
পিএটিসির সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, শর্ত শিথিল করা বেআইনি হয়নি। তবে এখানে পরোক্ষভাবে বোঝা যাচ্ছে, ঘরের মানুষের জন্য শর্ত শিথিল করা হয়েছে। নিয়োগ নিয়ে স্বজনপ্রীতির প্রশ্ন উঠতেই পারে।
অন্যদিকে সরকারি চাকরিবিধি-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, ডাটা সেন্টার একটি কোম্পানি হলেও এটি যেহেতু সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন, তাই এখানকার কেউও দলীয় পদে থাকতে পারেন না।