ডেঙ্গু আক্রান্ত জটিল রোগীর সেবায় দিনরাত একাকার করে দিয়েছিলেন তরুণ চিকিৎসক শরিফা বিনতে আজিজ। তাঁর সেবা আর চিকিৎসায় অনেক ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুপথ থেকেও ফিরেছিলেন। তবে পারলেন না নিজেকে বাঁচাতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ২৭ বছর বয়সী এই চিকিৎসক গতকাল শুক্রবার ভোরে হারলেন এডিস মশার ছোবলে।
শুধু শরিফা নন, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নিভে গেছে পাঁচ চিকিৎসকের প্রাণ। তাদের চারজন নারী ও একজন পুরুষ। যাদের বয়স ৩৫ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ চিকিৎসক ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, দেশে এ পর্যন্ত ২০৫ চিকিৎসক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন পাঁচজন। এ ছাড়া নার্স আক্রান্ত হয়েছেন ১০০ জনের বেশি।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে হাসপাতাল। ডেঙ্গু চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এজন্য হাসপাতালের আশপাশের এলাকায় ডেঙ্গু নিধন অভিযান ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি।
ছুটি নিয়ে চির ছুটিতে শরিফা
ব্যক্তিগত কাজে ৫ আগস্ট হাসপাতাল থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়েছিলেন শরিফা। দু’দিন পর ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাঁকে ঢামেক হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়ার পরামর্শ দেন। সে সময় ঢামেক হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার ফের ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করলে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। শুক্রবার ভোরে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর।
শরিফার মামা আবিদ হাসান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেলা হলো না তার। শত চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না। আমার ভাগনির বাড়ি ঢাকার দোহারের জয়পাড়া চৌধুরীপাড়া গ্রামে। তার বাবা আবদুল আজিজ। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে অবিবাহিত শরিফা ছিলেন বড়। রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এফসিপিএস করছিলেন। তাঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে গতকাল বিকেলে দাফন করা হয়।
হেরে যান চিকিৎসক আলমিনা
চিকিৎসক শরিফার মৃত্যুর তিন দিন আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ৩৩ বছর বয়সী চিকিৎসক আলমিনা দেওয়ান মিশু। সোমবার রাতে ঢামেক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু সর্বশেষ বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (আইসিএমএইচ) গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগে রেসিডেন্ট হিসেবে অধ্যয়নরত ছিলেন। গত ২৪ জুলাই তাঁর জ্বর আসে। ডেঙ্গু ধরা পড়লে প্রথমে বাসায়ই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। অবস্থা খারাপ হলে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢামেক হাসপাতালে তিনি মারা যান।
দেড় বছরের সন্তান রেখে ফাতেমার বিদায়
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২২ জুলাই বিদায় নেন সাভারের সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের ডা. ফাতেমা-তুজ-জোহরা রওনক। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ডা. রওনকের বয়স ছিল ৩২ বছর। তিনি দেড় বছর বয়সী ছেলে শিশু রেখে গেছেন।
সৈয়দা সাদিয়া ইয়াসমিন
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৫ জুলাই রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের অষ্টম ব্যাচের শিক্ষার্থী সৈয়দা সাদিয়া ইয়াসমিন (রাইসা) মারা যান। তিনি এমবিবিএস শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। রাইসার স্বামী তানজিম জানান, ১৮ জুলাই ডেঙ্গু পরীক্ষায় পজিটিভ আসে। এর পর তাঁর মৃত্যু হয়।
চিকিৎসক আরিফুর
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২২ জুন ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ডা. এম আরিফুর রহমান। তিনি বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৩৯তম ব্যাচের কর্মকর্তা। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ১৬তম ব্যাচে পড়াশোনা করেন ডা. আরিফ। চাকরির পাশাপাশি ঢামেকের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনে এমডি ফেইজে অধ্যয়নরত ছিলেন।
বাংলাদেশ চিকিৎসক ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. নিরুপম দাস বলেন, এখন যে হারে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, তা উদ্বেগজনক। ডেঙ্গু রোগীর সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হচ্ছেন কেন– এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হাসপাতাল এখন ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসক ও রোগীর সুরক্ষায় হাসপাতালে এডিস মশা নিধন অভিযান ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি। এ ছাড়া আক্রান্ত রোগীকে মশারির ভেতরে রাখা বাধ্যতামূলক করা উচিত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে মশার কামড় খেয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন। কোনো কোনো সময় ডেঙ্গুর উপসর্গ ছাড়াই আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই বারবার বমি হলে, খেতে না পারলে, ডায়রিয়া, রক্তক্ষরণ, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা এবং দুর্বল লাগলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আর ডেঙ্গু রোগী যদি নারী ও অন্তঃসত্ত্বা হন, ডায়াবেটিসসহ অন্য জটিলতা থাকে, স্থূলকায় হন– তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা বেশি থাকে। তাই ঝুঁকিতে যারা আছেন, তাদের জ্বর হলে ওই দিনই ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে এবং সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
শিক্ষক মোরশেদার মৃত্যু
ডেঙ্গুতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মোরশেদা বেগম মারা গেছেন। শুক্রবার সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ভিকারুননিসা ন্যূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী জানান, মোরশেদা ভিকারুননিসা বসুন্ধরা শাখার প্রভাতীর শিক্ষক ছিলেন। সম্প্রতি তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রথম কেমোথেরাপি নেওয়ার পর তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তার ডেঙ্গু হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলে শুক্রবার সকাল তাঁর মৃত্যু হয়।
ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়াল
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে আরও ২ হাজার ৪৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৩৭৩ জন মারা গেলেন। ১ জানুয়ারি থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮০ হাজার ৭৪ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৪০ হাজার ৭৬৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিলেন ২৮১ জন এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার ৭৬৪ জন।