জ্বালানি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের সংকট কাটছে না। বকেয়া পরিশোধে চাপ দিচ্ছে বিদেশি কোম্পানি। জ্বালানি তেলের আমদানির ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না নিয়মিত। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার ছাড় করার পর ঋণপত্র খুলছে ব্যাংক। এতে জ্বালানি তেলের সরবরাহ ধরে রাখা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মজুত প্রায় শেষের দিকে উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েলের। কমে আসছে ডিজেলের মজুতও।
ডলার-সংকটের বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে নিয়মিত জানাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এ নিয়ে অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছে মন্ত্রণালয়। তবে চাহিদামতো ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বিল দেরিতে পরিশোধের জন্য নিয়মিত জরিমানা দিতে হচ্ছে। অনিশ্চয়তা থাকায় আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো ঋণপত্রে নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এতে আমদানি খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
বিপিসি সূত্র বলছে, জেট ফুয়েলের মজুত দিয়ে আগামী ১ জানুয়ারি পর্যন্ত চালানো যেতে পারে। তবে জেট ফুয়েল ও ডিজেল নিয়ে আজ শুক্রবার দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসার কথা রয়েছে। জাহাজ থেকে তেল খালাস করে ডিপোতে সরবরাহ করতে দুই দিন লাগতে পারে। এতে সংকট তৈরি হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিপিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, দেড় কোটি ডলার বকেয়া ছিল জ্বালানি তেল সরবরাহকারী কোম্পানি পেট্রো চায়নার (সিঙ্গাপুর)। এক কোটি ডলার পরিশোধ করার পর নতুন জাহাজ পাঠায় কোম্পানিটি। কিন্তু বাকি বকেয়া পরিশোধ না করায় নতুন জাহাজ থেকে তেল খালাসের নিশ্চয়তা দিচ্ছিল না। গত বুধবার তাদের ৫০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এরপর গতকাল তারা পাওনা বুঝে পেয়ে তেল খালাসের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। আরেকটি তেল সরবরাহকারী কোম্পানি ইউনিপেক সিঙ্গাপুরের জাহাজও আসছে। দুটোই চীনের কোম্পানি।
এর আগে ১১ ডিসেম্বর জ্বালানি বিভাগে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছিল বিপিসি। এতে বলা হয়েছিল, দীর্ঘ বকেয়ার কারণে বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল বিলম্বে সরবরাহ বা বাতিলের প্রস্তাব করছে। বারবার অনুরোধ করলেও তারা রাজি হচ্ছে না। কেউ কেউ জাহাজ আসার তারিখ বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে। পেট্রো চায়না সিঙ্গাপুর অতিরিক্ত ডিজেল সরবরাহে অসম্মতি জানিয়েছে। নতুন জাহাজ আসার তারিখ জানাচ্ছে না সিঙ্গাপুরের ভিটল। এভাবে চলতে থাকলে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ডিজেল ও জেট ফুয়েলের মজুত প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসবে। ফলে জ্বালানি তেলের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
মজুত পরিস্থিতি ও বকেয়া
বিপিসি সূত্র বলছে, সাধারণত এক মাসের মজুত রাখা হয় জ্বালানি তেলের। গতকাল ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ডিজেলের মজুত সক্ষমতা ৬ লাখ টন, মজুত আছে ১ লাখ ৭০ হাজার টন। এ মজুত দিয়ে ১৪ থেকে ১৫ দিনের চাহিদা মেটানো যাবে। জেট ফুয়েলের মজুত সক্ষমতা ৬৫ হাজার ৮৩৮ টন, মজুত আছে ৯ হাজার ৬৮৫ টন। এটি দিয়ে আরও চার দিন চালানো যেতে পারে। তবে পেট্রল, অকটেন ও ফার্নেস তেলের পর্যাপ্ত মজুত আছে বিপিসির কাছে।
দেড় বছর ধরে জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে নিয়মিত ডলার পাচ্ছে না বিপিসি। বিল পরিশোধে ডলারের বিকল্প হিসেবে চীনের সঙ্গে ইউয়ান ও ভারতের সঙ্গে রুপিতে বিল পরিশোধে গত মে মাসে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয় বিপিসি। এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। গতকাল পর্যন্ত বিপিসির বকেয়া জমেছে ২৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। যদিও অক্টোবরে বকেয়া ৪৫ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল। চাপে পড়ে এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক পরিশোধ করা হয়েছে।
বছরে বিপিসির প্রায় ৬০ লাখ টন জ্বালানি তেল লাগে। এর মধ্যে দেশের একমাত্র পরিশোধনাগারের সক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ টন। বাকিটা সরাসরি আমদানি করা হয়। তবে দেশে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের মধ্যে ৭৫ শতাংশই ডিজেল। আর ডিজেলের ৮০ শতাংশ সরাসরি আমদানি করা হয়। জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিচ্ছে বিপিসির কাছে তেল বিক্রি করা বিদেশি সংস্থাগুলো।
বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জেট ফুয়েল শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বর্তমান মজুত ফুরানোর আগেই নতুন তেল ডিপোতে যুক্ত হবে। দুটি জাহাজে নতুন করে ৩১ হাজার টন জেট ফুয়েল আসছে। ডিজেলেরও মজুত আছে, আরও আসছে। জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
জ্বালানি চাহিদা বাড়বে গ্রীষ্মে
আগামী জানুয়ারিতে শুরু হয়ে এপ্রিল পর্যন্ত থাকবে সেচ মৌসুম। গত বছরের তুলনায় এবার বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সব ধরনের জ্বালানি মজুতের কথা বলেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। চাহিদা অনুসারে ফার্নেস ও ডিজেল সরবরাহ করা যাবে বলে জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
সেচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে গতকাল বিদ্যুৎ ভবনে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় পর্যালোচনা সভা হয়েছে। এতে বলা হয়, গত সেচ মৌসুমে গ্রীষ্মের বাড়তি চাহিদা মিলে এপ্রিলে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এবার সব মিলে এটি ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট হতে পারে। তাই গ্যাস, ফার্নেস তেল ও ডিজেলের সরবরাহ বাড়ানো প্রয়োজন হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, দুই মাস বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মতো জ্বালানি তেলের মজুত রাখতে হবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ১৫৪ থেকে ১৭৬ কোটি ঘনফুট হতে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফার্নেস তেল লাগবে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫০ টন, ডিজেল লাগবে ১৫ হাজার ৬০০ টন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র নিজেরাই ফার্নেস তেল আমদানি করে। তাদের বিল বকেয়া ও ঋণপত্র খোলার জটিলতা আছে। তাই সব মিলিয়ে জ্বালানির সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা আছে। বিশেষ করে গ্যাসের চাহিদা পূরণ করা কঠিন। গত গ্রীষ্ম মৌসুমে জ্বালানির অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। এতে নিয়মিত লোডশেডিংয়ে ভুগেছে সাধারণ মানুষ। ঢাকার চেয়ে বাইরে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং হয়েছে বেশি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, বিল বকেয়া রাখতে থাকলে একপর্যায়ে সরবরাহকারীরা সমস্যা তৈরি করবেই। এভাবে চলতে থাকলে একসময় কেউ কেউ হয়তো বাংলাদেশের সঙ্গে তেল সরবরাহের ব্যবসা বন্ধ করে দেবে। তাই অগ্রাধিকার দিয়ে জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে ডলার সরবরাহ করা উচিত।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম