ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার পথে বাংলাদেশ

0
235
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সমীক্ষা

গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং ফার্ম বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের (বিসিজি) এক সমীক্ষায় এসব চিত্র উঠে আসে। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে করা ওই সমীক্ষার ফলাফল গত ২৫ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে তারা। ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিসিজির গ্লোবাল চেয়ার ইমেরিটাস হ্যান্স-পল বার্কনার বলেন, ‘বাংলাদেশ অন্যান্য উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য রোল মডেল। এই দেশ ইতিমধ্যে অনেক কিছু অর্জন করেছে। বেসরকারি খাতের অপরিসীম অবদানের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর রূপান্তর ও দেশের বেসরকারি খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান এই অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছে।’

বাংলাদেশকে উদীয়মান পাওয়ার হাউস বা শক্তিকেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিসিজি। তাদের মতে, এই শক্তিকেন্দ্রের ভিত বা পিলার আটটি। সেগুলো হচ্ছে—দৃঢ় আশাবাদ, ভোক্তাশ্রেণির উত্থান, ক্রমবর্ধমান তরুণ কর্মশক্তি, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা বা ঘাতসহতা, ডিজিটাল অর্থনীতির গতি, সরকারি বিনিয়োগ, বেসরকারি খাত, উদীয়মান গিগ অর্থনীতি (ইন্টারনেটভিত্তিক খণ্ডকালীন কাজ)।

ভোক্তাদের দৃঢ় আশাবাদ

বাংলাদেশের ভোক্তাদের আশাবাদ অনেক বেশি। তাঁরা মনে করেন, ভবিষ্যতেও তাঁদের ক্রয়সক্ষমতা থাকবে। এই আশাবাদ বিগত দশকে দেশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করেছে, যদিও সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে সেই আশাবাদ কিছুটা নিম্নমুখী। এরপরও ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতার প্রত্যাশা, অর্থনীতির দক্ষতাভিত্তিক রূপান্তরের কারণে আগামী প্রজন্ম উন্নত জীবন যাপন করতে পারবে।

ভোক্তাশ্রেণির উত্থান

গত ৩০ বছরে দেশে বড় ভোক্তাশ্রেণি তৈরি হয়েছে। গত শতকের ১৯৯০–এর দশকের গোড়ার দিকে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে ও বিশ্বায়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়। তৈরি পোশাক খাত, ওষুধসহ রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে ওঠে। দারিদ্র্য দ্রুত কমতে শুরু করে। ভোক্তাশ্রেণি গড়ে ওঠে। বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৬৯ শতাংশ জোগান দিচ্ছে অভ্যন্তরীণ ভোক্তাশ্রেণি।

বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০৩০ সালে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিকে টপকে বাংলাদেশের ভোক্তাশ্রেণি হবে বিশ্বের নবম বৃহত্তম। এ ছাড়া ২০২৫ সালে বাংলাদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবৃদ্ধি ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের চেয়েও বেশি হবে। বিসিজির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২০ সালে বাংলাদেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ, যা ২০২৫ সালে ৩ কোটি ৪০ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে।

ক্রমবর্ধমান তরুণ কর্মশক্তি

বিপুলসংখ্যক তরুণ কর্মশক্তি বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখার জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশের মানুষের গড় বয়স বর্তমানে ২৮ বছর, যা ইন্দোনেশিয়ায় ৩১, ভারতে ২৯, থাইল্যান্ডে ৩৯, ভিয়েতনামে ৩২ বছর। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় ৩০ বছর। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দুই–তৃতীয়াংশ বা ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ কাজের উপযোগী। এর মানে ১১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ কর্মক্ষেত্রে মূল্য সংযোজনে প্রস্তুত।

অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা

বাংলাদেশের পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক ঘাতসহতা অনেক বেশি। সেই সঙ্গে জাতীয় ঋণের পরিমাণ কম হওয়াও একরকম আশীর্বাদ বটে। এ দেশের মানুষের সঞ্চয়ের হার বিশ্বের গড় হারের চেয়ে বেশি। এখানকার মানুষের সঞ্চয়ের হার মোট জাতীয় আয়ের ৩৪ শতাংশ, যেখানে বৈশ্বিক হার ২৭ শতাংশ। এ ছাড়া জিডিপির প্রায় ৬৯ শতাংশ অভ্যন্তরীণ ভোগ থেকে আসার কারণে বাহ্যিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি একরকম সুরক্ষিত রয়েছে।

আবার সমপর্যায়ের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় ঋণের পরিমাণও কম, তা জিডিপির মাত্র ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে জাতীয় ঋণ ভিয়েতনামে ৩৯, ইন্দোনেশিয়ায় ৪১, থাইল্যান্ডে ৫৩, ভারতে ৫৬ ও ফিলিপাইনে ৬১ শতাংশ। উচ্চ সঞ্চয়ের কারণে ২০২১ সালে এ দেশের গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফরমেশনের হার ছিল জিডিপির ৩১ শতাংশ, যা এশিয়ার অন্যান্য সমপর্যায়ের দেশের তুলনায় বেশি।

আবার প্রবাসী আয় আসার উচ্চগতি অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতা দিয়েছে। ২০২০ সালে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল, যা গত বছর দ্বিগুণ বা ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার হয়েছে।

ডিজিটাল অর্থনীতির গতি

বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির গতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ডিজিটাল মাধ্যমে ভোক্তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। গত ১০ বছরে মোবাইল ফোনের গ্রাহকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে মোবাইল ফোনের মোট গ্রাহকসংখ্যা ছিল ১৭ কোটি ৭০ লাখ। এ ছাড়া গত এক দশকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ডিজিটাল অর্থনীতির পরিবেশ উন্নত হওয়ায় প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক সেবায় লেনদেন ৩৫০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে যা ছিল ১৭০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। তার মানে চার বছরের ব্যবধানে তা দ্বিগুণ হয়েছে।

সরকারের সক্রিয় ভূমিকা

সরকারের সক্রিয় ভূমিকাও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে। গত এক দশকে সরকারের ব্যয় চার গুণ বেড়েছে। ২০১২ সালে যেখানে সরকারের ব্যয় ছিল ৫৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার, সেখানে তা চলতি বছরে বেড়ে ২ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার হয়েছে। সেই সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে সরকারের প্রচেষ্টায় এ দেশে সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আবার মাথাপিছু বিদ্যুৎ সরবরাহ ৩০০ কিলোওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া বড় কিছু পরিকল্পনা যেমন—স্মার্ট বাংলাদেশ আইসিটি ২০৪১ ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেবে।

দ্রুতবর্ধনশীল বেসরকারি খাত

বাংলাদেশের বেসরকারি খাত সম্প্রসারণশীল, যা প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি। বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনেক বড় হয়েছে, যাদের কারণে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলেই মনে করছে বিসিজি।

বৈশ্বিক বস্ত্র ও পোশাক খাতের সরবরাহব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী। এই খাতের আরও প্রবৃদ্ধি হবে। কারণ, বড় বড় পোশাক রপ্তানিকারকেরা বিশ্বব্যাপী বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের বিকাশ হয়েছে। যদিও মাত্র তিনটি কোম্পানি—গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের হাতেই সিংহভাগ বাজার। তাদের হাত ধরে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের নবম বৃহত্তম মোবাইল বাজার। দেশের প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা আছে বেসরকারি সংস্থার (এনজিও)। এর মধ্যে বিশেষ করে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও ব্র্যাক ও ক্ষুদ্রঋণের অগ্রগামী গ্রামীণ ব্যাংক সমাজের একদম নিচু তলার মানুষের সুরক্ষা দিচ্ছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোও বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। দেশে এখন স্টার্টআপ কোম্পানির সংখ্যা ১ হাজার ২০০। স্টার্টআপগুলো বিভিন্ন খাতে ব্যবসা করছে, যার মধ্যে আছে প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক সেবা, ই-কমার্স ও লজিস্টিকস। মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশ বাংলাদেশের প্রথম ইউনিকর্ন (মূল্যমান ১০০ কোটি ডলার), যেখানে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সফট ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে। বর্তমানে বিকাশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এমএফএস কোম্পানি। গত কয়েক বছরে আরও কয়েকটি কোম্পানি ইউনিকর্ন হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়েছে, যার মধ্যে আছে শপআপ, চাল ডাল ও পাঠাওয়ের মতো প্রতিষ্ঠান। স্টার্টআপ খাত প্রায় ৭০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে। সরকারও স্টার্টআপ বাংলাদেশ নামে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিল গঠনের মাধ্যমে খাতটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলোর কথাও বিসিজির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিশেষ করে প্রাণ-আরএফএল কোম্পানির কথা বলা হয়েছে, যারা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। ওষুধ কোম্পানি রেনাটার কথা বলা হয়েছে, যারা সম্প্রতি ইউরোপ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি শুরু করছে। করপোরেট খাতে বিশেষ নৈপুণ্য দেখানোর জন্য স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও রেনাটা লিমিটেডের নাম ফোর্বস–এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তালিকায় উঠে এসেছে।

পেছনের রহস্য কী

বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের (বিসিজি) প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উদীয়মান কোম্পানিগুলোকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিসিজির ভাষ্য, ভবিষ্যতে আরও বড় হওয়ার মতো সুযোগ রয়েছে তাদের। সাহসের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নেওয়া—এই মানসিকতা কোম্পানিগুলোর বড় গুণ।

বিসিজির সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ৫৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই অর্থপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রাখে। ৮৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সাহসী। ৩৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আরও উন্নত সেবা দিতে চায়। ৭৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস করে, সার্বক্ষণিক পরিবর্তনের সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। ৬১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হওয়ার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের বিস্তৃত করতে চায়।

ভবিষ্যতে সাফল্যের জন্য

আগামী দিনে উদীয়মান চ্যাম্পিয়ন কোম্পানিগুলোকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহে আরও দক্ষ হতে হবে। বেসরকারি মূলধন ও ব্যক্তিগত অর্থায়নের ওপর ভর করেই করপোরেট খাত প্রাথমিকভাবে বেড়ে উঠছে। কিছু ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছে কিছু প্রতিষ্ঠান। তবে বাংলাদেশের কিছু উদীয়মান চ্যাম্পিয়ন, যেমন সামিট, শপআপ, বিকাশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহ করেছে।

অবশ্য কোনো আখ্যানই একরৈখিক নয়, উত্থান-পতন সব জাতির জীবনেই আসে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটসহ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। এই পরিস্থিতিতে কিছু অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। বিসিজি মনে করে, সরকার যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে এক লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতি হওয়ার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

প্রতীক বর্ধন ও
শুভংকর কর্মকার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.