যে কোনো দেশের নিজস্ব মুদ্রার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার দর ওঠানামা হবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে দর অস্বাভাবিক বেড়ে যেন মূল্যস্ম্ফীতিতে চরম আঘাত হানতে না পারে। সে জন্য বাজারভিত্তিক বলা হলেও কৌশলগত নানা উপায়ে মুদ্রাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়তি চাহিদার সময়ে রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে দর নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই ব্যবস্থা ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং’ হিসেবে পরিচিত। তবে বাংলাদেশে এতদিন কৃত্রিমভাবে দর ধরে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের দেশে-দেশে পণ্যের দর অস্বাভাবিক বেড়েছে। যে কারণে আর দর ধরে রাখতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের দর এক বছরে রেকর্ড ২৫ শতাংশের মতো বেড়েছে। আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে ১০৬ থেকে ১০৭ টাকা দিয়েও এখন ডলার পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। ২০২২ সালের শুরুর দিকেও আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক একসময় কোন ক্ষেত্রে ডলারের দর কী হবে তা ঠিক করে দিত। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ১৯৮৭ সালে তা বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর থেকে লিখিত কোনো নির্দেশনা না দিলেও সব সময়ই ডলারের দর নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েক বছর কৃত্রিমভাবে দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বেশি হয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদরা বেশ আগে থেকে ডলারের দর প্রকৃত অর্থে বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তাতে কান না দিলেও করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অনেক ক্ষেত্রে তা আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ায় ডলারের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনা উপেক্ষা করে ব্যাংকগুলো ডলার সংগ্রহে হুড়োহুড়ি শুরু করে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি এ চাপ বেশি বেড়ে যায়। রপ্তানিকারক ও রেমিটারদের থেকে অনেক বেশি দরে ডলার কিনতে শুরু করে ব্যাংকগুলো। মাঝে রেমিট্যান্সে ডলারের দর ১১০ থেকে ১১৪ টাকায় উঠে যায়। খোলাবাজারে নগদ ডলারের দর ওঠে ১১৯ টাকায়।
এভাবে দর বেড়ে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর ওপর নানা উপায়ে চাপ তৈরি করে। শুরুতে অতিরিক্ত মুনাফার কারণে ১২টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরপর বড় ব্যাংকগুলোকে কিছুটা বশে এনে সব পর্যায়ে অভিন্ন দর নির্ধারণে বাধ্য করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ব্যাংকগুলো এখন রপ্তানিকারকদের থেকে ১০০ টাকায় ডলার কিনছে। প্রবাসীদের থেকে কিনছে ১০৭ টাকায়। ডলার কেনার গড় দরের ভিত্তিতে আমদানিতে ডলারের দর নির্ধারিত হচ্ছে।
গত সেপ্টেম্বরে ডলারের দর নির্ধারণের পর থেকে রেমিট্যান্স আরও কমছে। জুলাই-আগস্ট দুই মাসে ৪১৩ কোটি ৩২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। পরের তিন মাসে এসেছে ৪৬৬ কোটি ডলার। মূলত হুন্ডিতে বেশি দর পাওয়ায় প্রবাসী অনেকে সেই পথে কষ্টের আয় পাঠাচ্ছেন। এ উপায়ে ডলার দেশে না এলেও টাকা পেয়ে যাচ্ছেন গ্রহীতারা।
ডলার সংকটের কারণে নতুন করে এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না বেশিরভাগ ব্যাংক। আগের দেনা পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। পরিস্থিতি সামলাতে রিজার্ভ থেকে ডলারের জন্য ধরনা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবে রিজার্ভ ব্যাপক কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি কিছু পণ্যের বাইরে ডলার সহায়তা দিচ্ছে না। এরপরও ২০২২ সালে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১ হাজার ২৬১ কোটি ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। এর বিপরীতে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ডলার বিক্রির প্রভাবে রিজার্ভ কমে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। অবশ্য দেশে এখন ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ রয়েছে ২৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। ২০২১ সাল শেষে দেশের রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়িয়েছিল ২০২১ সালের আগস্টে। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) বড় অঙ্কের দেনা পরিশোধ করতে হবে। ফলে রিজার্ভ আরও কমবে।
কোনো একটি দেশের ছয় মাসের বেশি আমদানি দায় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকাকে স্বস্তিদায়ক মনে করা হয়। নূ্যনতম তিন মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ না থাকলে সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে আমদানিতে বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে ৬৩৭ কোটি ডলার ব্যয় হচ্ছে। এ বিবেচনায় ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের বিপরীতে চার মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ রয়েছে। দেশের বাইরে থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধেও চাপ বাড়ছে। এতে করে রিজার্ভ আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে চার মাসের কম আমদানি দায় মেটানোর মতো ডলার থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে।
পরিস্থিতি যেন খুব খারাপ না হয় সে জন্য টিভি, ফ্রিজ, স্বর্ণসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানিতে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ, জ্বালানির বাইরে অন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ মার্জিনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর জন্য এসব পণ্য আমদানিতে ঋণ দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ এবং ডলার সংকটের কারণে নতুন এলসি খোলা কিছুটা কমেছে। তবে আগের আমদানি দায় পরিশোধের কারণে বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবেও বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
ডলারের দর বৃদ্ধি ও সংকটের প্রভাবে একদিকে পণ্যমূল্য অনেক বেড়েছে। আরেকদিকে ব্যাংক থেকে টাকা উঠে আসায় অভ্যন্তরীণ তারল্যের ওপরও চাপ তৈরি হয়েছে। কেননা উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে এমনিতেই সঞ্চয়প্রবণতা কমছে। সেই সঙ্গে অপ্রচারসহ বিভিন্ন কারণে অনেকে আতঙ্কে ছিলেন। এর মধ্যে আবার ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্য জানাজানির পর বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে সঞ্চয়প্রবণতা কমে তারল্য সংকটে পড়েছে পুরো ব্যাংক খাত। বেশ কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা বা সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বাজার সামলাতে চলতি বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭৪৭ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বিক্রি করা হয় আরও ৫১৪ কোটি ডলার। এ সময়ে কোনো ডলার কিনতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে কখনও এত বেশি ডলার বিক্রির প্রয়োজন হয়নি। মূলত গত বছরের জুলাই থেকে ডলারের ওপর চাপ বাড়তে শুরু করে। ২০২১ সালের শেষ ছয় মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ২৫২ কোটি ডলার বিক্রি করে। প্রথম ছয় মাসে যেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কিনেছিল ২৬৫ কোটি ডলার। করোনার মধ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর উদ্বৃত্ত ডলার জমা হওয়ায় ২০২০ সালে ৬৩৭ কোটি ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিক্রি ছিল মাত্র ৬৩ কোটি ডলার। এখন ডলার বিক্রি বাড়ানোর পরও বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে ৯৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে। চলতি বছরের শুরুর দিকেও বিক্রি করা হয় ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। তবে ব্যাংক বা আমদানিকারক চাইলেই ডলার দেওয়া হয় তেমন না। শুধু সরকারি এলসির দায় মেটাতে ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ করে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সার, জ্বালানি, জরুরি খাদ্যপণ্য আমদানির বিপরীতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোকে এ ডলার দেওয়া হয়। এর বাইরে জ্বালানি আমদানির জন্য বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের কিছু ডলার দেওয়া হয়। এখন আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে ১০৬ থেকে ১০৮ টাকা খরচ হচ্ছে। খোলাবাজারে এখন প্রতি ডলার ১১০ থেকে ১১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সংকট মেটাতে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও ডলার সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এ ছাড়া সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে রমজান মাসের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ডলার সহায়তা করতে বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আপাতত ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব উৎস থেকেই ডলার সংগ্রহ করে এলসি খুলতে হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ডলার সহায়তার সুযোগ নেই বলে জানানো হচ্ছে। এ জন্য রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে দেশের বাইরে নিজস্ব এক্সচেঞ্জ হাউস খোলা, রেমিট্যান্স পাঠাতে সার্ভিস চার্জ না নেওয়াসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ওবায়দুল্লাহ রনি