টর্চার সেলে মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে গ্রেপ্তার দুই রাজাকার

0
219
নকিব হোসেন আদিল ও মোখলেসুর রহমান মুকুল

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। সোমবার রাতে রাজধানীর দক্ষিণখান ও আশুলিয়া এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরে কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান। গ্রেপ্তার দুই আসামি হলেন- নকিব হোসেন আদিল ও মোখলেসুর রহমান মুকুল।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাকচর গ্রামের ইউনুছ আলী নামক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা নদী পারাপারে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা জুন-জুলাইয়ের দিকে ত্রিশালের আহমেদাবাদে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযোদ্ধাদের নদী পারাপারে সহযোগিতার কারণে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ইউনুছ আলীকে রাজাকারদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় এবং রাজাকার ক্যাম্পের টর্চার সেলে নির্যাতনের পর ১৫ আগস্ট সকালে তাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।

এ ঘটনায় শহীদ ইউনুছ আলীর ছেলে রুহুল আমিন ২০১৫ সালে ময়মনসিংহের আদালতে এ মামলা দায়ের করলে পরে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলা নং-০৭/২০১৮ রুজু হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় উভয়ের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।

র‍্যাব জানায়, ২০১৭ সালে বর্ণিত অভিযোগের তদন্ত শেষে তদন্ত সংস্থা নকিব হোসেন আদিল ও মোখলেছুর রহমান মুকুলসহ ০৯ জনকে অভিযুক্ত করে বিজ্ঞ আদালতে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। উক্ত মামলায় আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। মামলার অভিযুক্ত দুইজন আসামি রায়ের আগে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে এবং গত ২৩ জানুয়ারি নকিব হোসেন আদিল ও মোখলেছুর রহমান মুকুলসহ সাতজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন।

র‍্যাব পলাতক দুই আসামি গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার রাতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নকিব হোসেন ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয় এবং পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে তাদের বিভিন্ন কাজে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে। সে ১৯৭১ সালে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় স্থানীয় রাজাকার বাহিনী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নকিব হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়ে ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় স্বাধীনতাকামী নিরীহ বাঙালিদের আটক, নির্যাতন, অপহরণ, হত্যা, লুটপাট, ঘরবাড়ি লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে জানা যায়।

নকিব হোসেন ২০১৫ সালে মামলার তদন্তকাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই পলাতক ছিল। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে আত্মগোপনে চলে যায়। এ সময় সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার এড়াতে ময়মনসিংহের নিজ এলাকা ত্যাগ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে এবং একাধিকবার বাসা পরিবর্তন করে। সর্বশেষ সে ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায় বসবাস করে আসছিল।

পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সে অন্যের রেজিস্ট্রেশনকৃত সীমকার্ড দিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করত। সে ও তার ছেলে-মেয়েরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ায় প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য তারা নিয়মিত তাকে অর্থপ্রদান করত। আত্মগোপনে থাকাকালে সে সাধারণত জনসমাগম স্থান, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াও তার ব্যক্তিগত পরিচয় প্রকাশ পায় এমন স্থান এড়িয়ে চলত।

র‍্যাব আরও বলে, গ্রেপ্তারকৃত মোখলেছুর রহমান মুকুল মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয় এবং পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে তাদের বিভিন্ন কাজে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। সে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ত্রিশাল এলাকায় স্থানীয় রাজাকার বাহিনী গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মোখলেছুর রহমান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় স্বাধীনতাকামী নিরীহ বাঙালিদের আটক, নির্যাতন, অপহরণ, হত্যা, লুটপাট, ঘরবাড়ি লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে।

মোখলেছুর রহমান ২০১৫ সালে মামলার তদন্ত কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই পলাতক ছিল। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে সে আত্মগোপনে চলে যায়। পরবর্তীতে ময়মনসিংহে নিজ এলাকা ত্যাগ করে ২০১৭ সাল থেকে ঢাকার আশুলিয়া ইপিজেড এলাকায় বিভিন্ন ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করে।

উল্লেখ্য, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ২৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালের মোখলেসুর ও নকিবসহ ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। দণ্ড মাথায় নিয়ে এখনো পলাতক রয়েছেন অপর চার আসামি সাইদুর রহমান রতন, শামসুল হক ফকির, নুরুল হক ফকির, সুলতান মাহমুদ ফকির। তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিশাল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা এবং হিন্দুদের নিপীড়নের মত ছয় ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের ওই মামলায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.