দেশের গবেষকেরা ইতিমধ্যে পাট ও ভুট্টা থেকে পলিব্যাগের বিকল্প ব্যাগ বানিয়েছেন। সেই তালিকায় নতুন ধরনের পচনশীল ব্যাগ সংযোজন করেছেন দুই তরুণ রাশিক হাসান ও রিয়াসাত জামান। তাঁরা তৈরি পোশাক কারখানার ফেলে দেওয়া বা অব্যবহৃত টুকরো কাপড় দিয়ে পলিব্যাগের বিকল্প ব্যাগ তৈরি করছেন।
পোশাক কারখানায় জামাকাপড় তৈরির পর বাড়তি যে কাপড় রয়ে যায়, তা কিন্তু ফেলনা নয়। এই ঝুট কাপড় সংগ্রহ করে তা দিয়ে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরি করছেন দেশের দুই তরুণ। অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারযোগ্য এসব ব্যাগ।
নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মোড়কে প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণে পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। দিন দিন এ ধরনের ব্যাগের ব্যবহার বাড়ছেই। কিন্তু এসব পলিব্যাগ পচনশীল না হওয়ায় ভূমি বা জলভাগে পতিত হয়ে তা পরিবেশের ক্ষতি করে। এ অবস্থায় পলিব্যাগের বিকল্প কী হতে পারে?
দেশের গবেষকেরা ইতিমধ্যে পাট ও ভুট্টা থেকে পলিব্যাগের বিকল্প ব্যাগ বানিয়েছেন। সেই তালিকায় নতুন ধরনের পচনশীল ব্যাগ সংযোজন করেছেন দুই তরুণ রাশিক হাসান ও রিয়াসাত জামান। তাঁরা তৈরি পোশাক কারখানার ফেলে দেওয়া বা অব্যবহৃত টুকরো কাপড় বা ঝুট দিয়ে পলিব্যাগের বিকল্প ব্যাগ তৈরি করছেন। এরই মধ্যে গড়ে তুলেছেন কারখানাও। তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম ইকোভিয়া।
সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ইকোভিয়ার সহপ্রতিষ্ঠাতা রাশিক হাসানের সঙ্গে। তিনি জানান, সাধারণভাবে তাঁদের তৈরি ব্যাগ দেখতে পলিথিন ব্যাগের মতোই মনে হয়। কিন্তু সেটি পচনশীল। মাত্র ১৫০ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে মাটিতে মিশে যায় পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ। অব্যবহৃত টুকরো কাপড় বা ঝুট থেকে পাওয়া যায় মূল কাঁচামাল সেলুলোজ। এটি দিয়েই পরে প্রক্রিয়াজাত করে বানানো হয় এ পলিব্যাগ।
ইকোভিয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। পরিবেশদূষণ কমাতে প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প তৈরির বিষয়টি মাথায় রেখেই এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। শুরুতে রাশিক হাসান ও রিয়াসাত জামানের সঙ্গে এ উদ্যোগে জড়িত ছিলেন তাঁদের আরেক বন্ধু আশফাকুল আলমও। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ও বাসার ল্যাবে পচনশীল পলিমার আবিষ্কারের মাধ্যমে তাঁদের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৯ সালে তাঁরা এই আবিষ্কার নিয়ে অংশ নেন বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) আয়োজিত তরুণ উদ্যোক্তা প্রতিযোগিতায়। সেখানে তাঁরা প্রথম স্থান অধিকার করেন। ফলে তাঁদের এ উদ্ভাবনকে বাস্তব রূপ দিতে আট লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দেয় বিওয়াইএলসি।
সেই অর্থায়নে ছোট একটি কারখানাও গড়ে তোলেন তিন বন্ধু মিলে। যদিও আশফাকুল আজম এখন আর এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নেই। কারখানা চালুর পর ২০২০ সালে তাঁরা প্রথম ক্রয়াদেশ পান দেশীয় খাবারের কোম্পানি রাসটিক ইটারি থেকে। এরপর ওই বছরের জুনে ডেকো ইশো গ্রুপ প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা অর্থায়ন করে ইকোভিয়াকে। এরপর বড় পরিসরে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
ইকোভিয়ার প্রধান ক্রেতা পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো। বর্তমানে তারা চার ধরনের বেশি পচনশীল ব্যাগ তৈরি করেন। এর মধ্যে রয়েছে পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত ব্যাগ, পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত বড় শিট, মুদিদোকানে ব্যবহৃত ব্যাগ ও খাবার বহন করার ব্যাগ। পাশাপাশি আরও কয়েক ধরনের পণ্য তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।
বর্তমানে তাঁদের তৈরি পণ্যগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও পেয়েছে। এখন তাঁরা তাঁদের এ উদ্ভাবনের মেধাস্বত্বের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কর্ণধার রাশিক হাসান জানান, সম্প্রতি তারা আন্তর্জাতিক মান যাচাইকারী কর্তৃপক্ষ টি–ইউ–ভি রেইংল্যান্ড থেকে পচনশীলতার সনদ পেয়েছেন। এর মাধ্যমে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি আরও বৃদ্ধি পাবে।
রাশিক হাসান আরও জানান, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাঁরা প্রায় ১০ কোটি টাকা মুনাফা করতে পারবেন। আর ২০২৬ সালের মধ্যে তাঁদের কোম্পানিটি হবে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। মাত্র তিনজন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ইকোভিয়া। বর্তমানে সেখানে ২৮ জন কর্মী কাজ করছেন। প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটি ১৩ লাখ পচনশীল ব্যাগ বিক্রি করেন। যার মধ্যে ১০ লাখ ব্যাগ রপ্তানি করা হয়। আর বাকি ৩ লাখ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়।
উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় পরিবেশদূষণ কমানোর বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে বাজারের প্রচলিত পলিব্যাগের তুলনায় তাঁদের উৎপাদিত ব্যাগের উৎপাদন খরচ কিছুটা বেশি পড়ে। ইকোভিয়ার প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা রিয়াসাত জামান বলেন, ঝুট কাপড় সংগ্রহ করে সেগুলোকে প্রাথমিক পর্যায়ে গরম ও ঠান্ডা পানিতে পরিষ্কার করার পর সেসব ঝুটকে পাউডারে রূপান্তর করা হয়। তারপর উৎপাদনের নানা ধাপ পেরিয়ে পচনশীল পলিমারে রূপ নেয়।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিদেশি ক্রেতা স্পেনভিত্তিক কটন ফাইবার উৎপাদক কোম্পানি রিকভার। কোম্পানিটির তৈরি ঝুট থেকেই তাদের জন্য প্যাকেজিং ব্যাগ বানিয়ে দেয় ইকোভিয়া। এর ফলে একটি বৃত্তাকার অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতি রাশিক হাসানের পরামর্শ, ‘উদ্যোক্তা হতে হলে থাকতে হবে সততা, অধ৵াবসায় এবং কষ্ট সহ্য করার মানসিকতা।’